জাহান্নামের খাবার
হযরত
জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী করীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন,
“তিনি বলেছেন, 'কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা কিছু
লোককে ছোট পিপিলিকার আকারে
তুলবেন। আর সব লোক
তাদের পদ-পিষ্ট করতে
থাকবে। জিজ্ঞেস করা হবে, পিপিলিকার
আকারে এসব লোক কারা?'
আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে বলা
হবে, 'দুনিয়াতে যারা অহংকার করতো
এসব লোক তারা।'
- ব্যাখ্যাঃ কোরআন এবং হাদীসে অহংকারের যে হাকীকত বর্ণিত হয়েছে তা হলো, যে মানুষ আল্লাহকে নিজের সৃষ্টিকর্তা ও প্রভু বলে জানে এবং মুখে তাকে সৃষ্টিকর্তা ও প্রভু বলে স্বীকারও করে কিন্তু বাস্তবে তাঁর হুকুমকে মানে না, তারাই অহংকারী। আল্লাহকে শ্রেষ্ঠ বলে যে নিজের বড়াই প্রকাশ করে সে অন্য
- মানুষকে অবশ্যই নীচ মনে করবে। ইবলীসও আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে স্বীকার করে, তাঁকে অনুগ্রহকারী ও নিয়ামতদাতা বলে মানে এবং বারংবার মুখে 'রব'ও বলে থাকে। কিন্তু যখন তাকে সিজদা করার আদেশ দেয়া হয়েছিল তখন সে তা অমান্য করে। এটাকেই আল্লাহতায়ালা অহংকার বলে অভিহিত করেছেন।
- হাদীসেও এ কথাই বলা হয়েছে। অহংকারকারীরা আল্লাহকে নিজের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা বলে স্বীকার করে এবং জানে যে, তাদের সৃষ্টিকর্তা নামাযকে ফরয করে দিয়েছেন, রোযা ফরয করে দিয়েছেন, যাকাত ফরয করে দিয়েছেন এবং হজ্জ ফরয করে দিয়েছেন। কিন্তু তারা নামায পড়ে না, রোযা রাখে না, যাকাত দেয় না এবং হজ্জ্বও আদায় করে না। অতএব এরাই সব থেকে বড় অহংকারী
মিরাজের ঘটনা ও
শিক্ষা
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “মিরাজের রাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এমন এক ঘোড়া নিয়ে আসা হয় যার গতি এত তীব্র ছিল যে, তার প্রতি পদক্ষেপ দৃষ্টির বাইরে চলে যেতো। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই ঘোড়ায় চড়ে জিবরাঈল আলাইহিস সালামের সঙ্গে যাত্রা শুরু করেন এবং আকাশে গিয়ে উপস্থিত হন।
যাওয়ার পথে
তিনি এমন কিছু লোককে
দেখেন যারা প্রত্যেক দিন
বীজ বপন করছিল ও
সেই দিন তা কেটে
নিচ্ছিল। আর কেটে নেবার
পর পুনরায় তাদের চাষ আগের মত
তৈরী হয়ে যাচ্ছিল। তিনি
জিজ্ঞেস করেন, 'হে জিবরাঈল আলাইহিস
সালাম, এসব লোক কারা?'
তিনি (জিবরাঈল আলাইহিস সালাম) জবাব দেন, 'এরা
হলো আল্লাহর পথে জিহাদকারী। এরা প্রত্যেক নেকীর বদলে সাত শত গুণ পুরস্কার পেয়ে থাকে।
এরা দুনিয়াতে যা কিছু খরচ করেছিল তার প্রতিদান পাচ্ছে।'
জাহান্নামের খাবার
তারপর
তিনি এমন কিছু লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করেন যাদের মাথা পাথর দিয়ে থেঁতলে ফেলা হচ্ছিল
এবং থেঁতলে দেবার পর তাদের মাথা আবার পূর্বের ন্যায় হচ্ছিল। লাগাতার তাদের সঙ্গে এ
রকম ব্যবহার করা হচ্ছিল।
তিনি
জিজ্ঞেস করেন, 'হে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম, এরা কারা?' তিনি (জিবরাঈল আলাইহিস সালাম)
জবাব দেন, ‘এসব লোক হলো তারা, যারা দুনিয়াতে নামাযের বিষয়ে অলসতা দেখাতো।' তারপর
তিনি এমন কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন যারা কেবল ছেঁড়া নেকড়া পরেছিল এবং যেভাবে
জানোয়ার খেয়ে থাকে সেভাবে গাছ-গাছড়া ও কাঁটাঝাড় ও জাহান্নামের গরম পাথর খাচ্ছিল।
(শরীরে বস্ত্রের নাম নেই, কেবল ছেঁড়া নেকড়া জড়ানো। খাওয়ার নাম নেই, সে জন্য ক্ষুধায়
কাতর হয়ে তারা যা খাচ্ছিল তা কোন খাবার জিনিস নয়)।
তিনি
জিজ্ঞেস করেন, 'হে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম, 'এসব লোক কারা?' তিনি (জিবরাঈল আলাইহিস সালাম)
জবাব দেন, ‘এসব লোক হলো তারা, যারা নিজের সম্পদের যাকাত দিত না। আল্লাহ তাদের উপর জুলুম
করেন নি, আল্লাহ তো বান্দার উপর আদৌ জুলুম করেন না।'
তারপর
তিনি এমন এক ব্যক্তিকে অতিক্রম করেন, যে খুব বড় বোঝা একত্রিত করছিল। সে বোঝাটি তুলতে
পারছিল না, তারপরও ক্রমাগত বোঝা বাড়িয়ে যাচ্ছিল। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
জিজ্ঞেস করেন, ‘এ ব্যক্তি কে?' তিনি (জিবরাঈল আলাইহিস সালাম) জবাব দেন, 'এ হলো আপনার
উম্মতদের সেই ব্যক্তি, যে বহুলোকের আমানত নিয়ে রেখেছিল কিন্তু তা আদায় করতে পারতো
না কিন্তু সে আরও অধিক আমানত কাঁধে নেয়ার জন্য ব্যস্ত থাকতো।'
তারপর
তিনি এমন কিছু লোকের নিকট উপস্থিত হন যাদের ঠোঁট ও জিভ কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছিল এবং
কাটার পর তা আবার পূর্বের ন্যায় হয়ে যাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে এ রকম আচরণ বার বার করা
হচ্ছিল।
তিনি
জিজ্ঞেস করেন, 'হে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম, 'এসব লোক কারা?' তিনি বললেন, 'এরা হলো সেই
সব বক্তা, যারা ফেতনা ও গুমরাহী ছড়াতো।' তারপর তিনি এক ছোট গর্তের নিকট উপস্থিত হন।
সেই ছোট গর্ত থেকে এক বলদ বের হয় ও পুনরায় তার মধ্যে প্রবেশ করতে চা, কিন্তু প্রবেশ
করতে পারে না।
তিনি
জিজ্ঞেস করেন, 'হে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম, 'এটা কি?' তিনি (জিবরাঈল আলাইহিস সালাম)
বললেন, 'এ ব্যক্তি নিজের মুখ দিয়ে এমন সব জঘন্য জঘন্য কথা বলতো যে, তারপর নিজেরই সে
জন্য আফসোস হতো এবং সে তা শুধরে নিতে চাইতো। কিন্তু মুখ দিয়ে একবার কোন কথা বেরিয়ে
গেলে তা কেমনভাবে ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব?” (তারগীব ও তারহীব)
আমানতের খেয়ানত, অপবিত্রতা, অশ্লীল কথা ও চোগলখুরীর শাস্তি
হযরত
শাফী ইবনে মাতি রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে
বর্ণনা করেন, “তিনি বলেছেন, 'জাহান্নামের মধ্যে চার ব্যক্তি এমন হবে যাদের জন্যে জাহান্নাম
বাসীরাও অসুবিধার মধ্যে পড়বে। তারা ফুটন্ত গরম পানি ও লেলিহান আগুনের মাঝে দৌঁড়াতে
থাকবে ও হায়! হায়!' করে চিৎকার করতে থাকবে। জাহান্নামবাসীরা একে অন্যকে বলবে, 'আমরা
তো এমনিতেই কষ্টের মধ্যে পড়েছিলাম, এসব দুর্ভাগারা এসে আমাদের আরও অধিক বিপদের মধ্যে
ফেলে দিয়েছে।'
হুজুর
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'এ চার ব্যক্তির মধ্যে একজনকে আগুনের সিন্দুকে
বন্ধ করে রাখা হবে, অন্য ব্যক্তির নাড়ি-ভুড়ি বেরিয়ে পড়বে ও সে সেই বেরিয়ে পড়া
নাড়ি-ভুড়ি নিয়ে এদিক ওদিক দৌঁড়াতে থাকবে, তৃতীয় ব্যক্তির মুখ দিয়ে রক্ত ও পুঁজ
বের হতে থাকবে এবং চতুর্থ ব্যক্তি নিজের গোস্ত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে থাকবে।'
সিন্দুকের
মধ্যে আবদ্ধ জাহান্নামীকে দেখে অন্যান্যরা বলবে, 'এ দূর্ভাগা ব্যক্তি যার পেরেশানীর
কারণে আমরাও কষ্টের মধ্যে পড়েছি, দুনিয়াতে কি করেছিল, কোন অপরাধের কারণে তাকে এই
শাস্তি দেয়া হচ্ছে?' আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘এ এমন অবস্থায় মরেছে যে তার কাছে অনেকের
অর্থ ছিল, তার ক্ষমতা ছিল কিন্তু সে অন্যের আমানত ফিরিয়ে দেয়নি ও ঋণ পরিশোধ করেনি।'
দ্বিতীয় ব্যক্তির বিষয়ে যখন জাহান্নামবাসীরা জানতে চাইবে তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন, 'এ ব্যক্তি নিজের প্রস্রাবের ছিটে থেকে বাঁচার জন্য যত্ন করতো না।' (পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার বিষয়ে উদাসীন ছিল)। এভাবে যখন তারা তৃতীয় ব্যক্তির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘যেমনভাবে ব্যভিচারীরা অশ্লীল কথা থেকে আনন্দ পায় তেমনভাবে এ ব্যক্তি মন্দ কথার প্রতি আকৃষ্ট হতো।'
আর পরিশেষে জাহান্নামবাসীরা যে নিজের গোস্ত ছিঁড়ে ছিঁড়ে
খাচ্ছিল সে ব্যক্তির বিষয়ে জিজ্ঞেস করবে। তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন, 'এ ব্যক্তি মানুষকে
অন্যের চোখে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যে তার পিছনে তার দোষ বর্ণনা করতো এবং যাতে মানুষের
মধ্যে সুমধুর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ও তারা পরস্পর লড়াই করে, ঝগড়া-ঝাটি করে
তার জন্যে এদিক ওদিক চোগলখুরী করে বেড়াতো।” (তারগীব ও তারহীব
জনসেবা করার ফজিলত
হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'আল্লাহ কিছু লোককে মানুষের প্রয়োজন পূরণ করার জন্যে সৃষ্টি করেছেন।
মানুষ আপন প্রয়োজন নিয়ে তাদের কাছে গিয়ে থাকে এবং তারা তাদের প্রয়োজন পূরণ করে
দেন। এ ধরনের লোক কিয়ামতের দিন আল্লাহর শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে।”
(তারগীব ও তারহীব, তাবরানী)
দীর্ঘ জীবন আখেরাতে মর্যাদা লাভের কারণ হতে পারে
হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “বনী উযরা গোত্রের তিন ব্যক্তি
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি সবাইকে
জিজ্ঞেস করেন, 'কে এ তিন জনের আতিথ্য করবে?' তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, 'আমি
এদের দেখাশোনার ভার নেবো।'
সুতরাং
তারা তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে থেকে যায়। পরে কোন এক সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু লোককে জিহাদে পাঠান। তাদের মধ্য থেকে একজন মুজাহিদদের সঙ্গে
যান এবং শাহাদাত লাভ করেন। তারপর দ্বিতীয় আরেকটি মুজাহিদ বাহিনী পাঠান হয়। সেই তিনজনের
আরো একজন এদের সঙ্গে যান এবং তিনিও শাহাদাত বরণ করেন। তৃতীয় ব্যক্তির স্বাভাবিক মৃত্যু
হয় নিজের বিছানায়।
তালহা
রাদিয়াল্লাহু বলেন, “আমি সেই তিনজন ব্যক্তিকে স্বপ্নে জান্নাতের মধ্যে দেখতে পাই।
যে ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে আপন বিছানায় মরেছেন তিনি তাদের সকলের আগে ছিলেন। তারপরে
দ্বিতীয় শহীদ এবং যিনি প্রথমে শহীদ হয়েছিলেন তিনি সকলের তৃতীয় স্থানে ছিলেন।
তালহা
রাদিয়াল্লাহু বলেন, 'এতে আমার মনে খটকা লাগে এবং আমি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
কাছে উপস্থিত হয়ে এ স্বপ্নের কথা বলি।' তিনি বলেন, ‘এতে তুমি অবাক হচ্ছো কেন? এটা
খুব পরিষ্কার কথা যে, যে মোমিন দীর্ঘ আয়ু লাভ করবে সে তাসবীহ, তাকবীর ও তাহলীল-এর
দ্বারা উঁচু স্থানই পাবে।' (তারগীব ও তারহীব)
- ব্যাখ্যাঃ তৃতীয় ব্যক্তি জিহাদের আকাঙ্খা রাখতেন কিন্তু মৃত্যু তাকে সে সুযোগ দেয়নি। এ ধরনের লোককে কিয়ামতের দিন শহীদদের মধ্যে গণ্য করা হবে। তিনি নিজের অন্য দুই সঙ্গী অপেক্ষা অধিক দীর্ঘ আয়ু লাভ করেন এবং এই আয়ুর অধিকাংশ সময় আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে কাটান। সুতরাং আখেরাতে তাঁর দুই সঙ্গী অপেক্ষা তাঁর উঁচু স্থানই পাওয়া উচিত, এটাই এ হাদীসে বলা হয়েছে।
পোস্ট ট্যাগঃ