দানের হাদিস

দানের হাদিস

দানের হাদিস

আত্মীয়-স্বজনকে দান করার পুরস্কার দ্বিগুণঃ হযরত সালমান ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, “তিনি বলেন, 'ফকীর মিসকীনকে দান করলে কেবল দানের সাওয়াব পাওয়া যায় কিন্তু গরীব আত্মীয়-স্বজনকে দান করলে দ্বিগুণ সাওয়াব পাওয়া যায়। একটি হলো দান করার সওয়াব এবং অন্যটি হলো আত্মীয়তার হক আদায় করার সওয়াব।” (নাসাঈ, তিরমিযী)

আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান দান কোনটি

হাকিম ইবনে হিযাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “এক ব্যক্তি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দান করার বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'কোন ধরনের দানের পুরস্কার ও সওয়াব অধিক?'

তিনি বললেন, 'সে দান সবচে উত্তম, যা মানুষ তার গরীব আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে থাকে, অথচ তার সে আত্মীয় তার প্রতি শত্রুতা রাখে।” (তারগীব ও তারহীব)

হযরত আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'হে আল্লাহর রাসূল। সওয়াবের দিক দিয়ে কার দানা উত্তম?'

তিনি বললেন, 'সে ব্যক্তির দান সব থেকে উত্তম, যার হাত অস্বচ্ছল, যার খরচ আয় অপেক্ষা বেশী আর যে খুব কষ্টে নিজের ও নিজের ছেলেমেয়ের লালন পালন করে থাকে। তিনি আরও বললেন, 'দান দেয়া শুরু করো ঐসব লোকের থেকে, যাদের দেখাশুনার ভার তোমার উপর ন্যস্ত।” (আবু দাউদ)

  • ব্যাখ্যাঃ এ হাদীসের শেষ অংশের অর্থ হলো, নিজের ঘর থেকেই দান করা শুরু করো। নিজের ছেলেমেয়ের জন্য খরচ করাও দান। এ জন্যও পুরস্কার পাওয়া যাবে। একথা ৮৮, ১৫০ এবং ১৫১ নং হাদীসেও বর্ণনা করা হয়েছে।

হযরত আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'মরার পরেও মোমিন কিছু নেক কাজের পুরস্কার অবিচ্ছিন্নভাবে পেতে থাকবে। যে লোক দ্বীনের জ্ঞান ও শিক্ষা মানুষকে দান করেছে, তার শেখানো লোকেরা যতদিন পর্যন্ত দুনিয়ায় নেক কাজ করতে থাকবে সেও ততদিন সওয়াব পেতে থাকবে। 

যদি কেউ নিজের সন্তানকে শিক্ষা-দীক্ষা দান করে যার ফলে সেই সন্তান নেককার হয়; তবে ওই সন্তান যতদিন নেক কাজ করতে থাকবে ততদিন তার পিতা-মাতাও সওয়াব পেতে থাকবে।

এভাবে কেউ যদি মসজিদ বা মাদ্রাসা বানিয়ে দিয়ে যায়, কোরআন চর্চার কেন্দ্র বা প্রতিষ্ঠান গড়ে দিয়ে যায়, মুসাফিরদের জন্যে কোন সরাইখানা বা আশ্রয়কেন্দ্র তৈরী করে দেয়, 

জনকল্যাণে খাল কাটায়, অথবা জীবনে অন্য কোন নেক কাজ করে এবং তাতে নিজের অর্থ খরচ করে, যতদিন পর্যন্ত লোকেরা তার থেকে উপকার পেতে থাকবে ততদিন পর্যন্ত দাতার আমলনামায় তার সওয়াব লেখা হতে থাকবে।” (ইবনে মাজাহ, ইবনে খোযায়মাহ, তারগীব)

  • ব্যাখ্যাঃ মানুষ যখন মরে যায় তখন তার আমলের খাতা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এমন কিছু জনকল্যাণমূলক নেক কাজ আছে যাকে আমরা সাদকা-এ-জারিয়া বলে থাকি। এই কাজগুলোর সওয়াবের ধারা ততক্ষণ পর্যন্ত শেষ হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তাতে উপকৃত হতে থাকে।
  • যতদিন মানুষ তার বানানো বা ওয়াক্ফ করা জিনিস থেকে উপকার পেতে থাকবে ততদিন পর্যন্ত তার আমলনামায় লাগাতার সওয়াব লেখা হতে থাকবে। সুতরাং মানুষের উচিত জীবদ্দশায় এমন ধরনের নেক কাজ বেশী করে করা, যার সওয়াবের ধারা সহজে শেষ হবে না।

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাতটি কাজের সাওয়াব বান্দা মরার পরও বরাবর পেতে থাকবে ৷

১. কেউ যদি কাউকে দ্বীনের শিক্ষা দান করে।

২. কোন খাল কাটায়

৩. কুয়া খনন করে দেয়

৪. বাগান লাগায়।

৫. মসজিদ তৈরী করে দেয়।

৬. কোরআনের উত্তরাধিকারী বানায়।

৭. এমন নেক সন্তান রেখে যায়, যে তার মৃত্যুর পর তার জন্য দোয়া ইসতেগফার করে।”

দান গ্রহণকারীর মর্যাদা

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'বিত্তবান দাতা গ্রহণকারী অপেক্ষা উত্তম নয় যদি গ্রহণকারী অভাবী হয়।” (তারগীব, তাবরানী)

  • ব্যাখ্যাঃ এ হাদীসে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হেদায়েত দান করেছেন যে, তোমরা সমাজের মধ্যে গরীব ও অভাবী ব্যক্তি অপেক্ষা নিজেকে উচুস্তরের মানুষ বলে মনে করো না। এও মনে করো না যে, তোমরা নিজের হক থেকে কিছু অংশ তাদেরকে দান করে তাদের উপর দয়া দেখাচ্ছো। না, তা নয়। বরং তোমাদের কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে সম্পদ আছে তা তো গরীবদেরই হক। 
  • তারা যদি তা গ্রহণ করে তবে তারা নিজেদের হকই গ্রহণ করে থাকে। তুমি তাদের উপর কি দয়া করলে, আর তাদের থেকে নিজকে কেন বড় মনে করবে? শুধু তাই নয়, বরং তার প্রতি তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ হলো আল্লাহর। আর গরীব মানুষ আল্লাহর তরফ থেকে আল্লাহর কর্মচারী আদায়কারী হয়ে তোমার কাছ থেকে আল্লাহর হক আদায় করে নেয়।

সম্পদ আল্লাহর কাছে জমা রাখা

হযরত হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবল পরাক্রান্ত মহামহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, 'আল্লাহতায়ালা বলবেন, 'হে আদম সন্তান, তুমি নিজের সঞ্চয়কে আমার কাছে জমা রেখে নিশ্চিত হয়ে যাও। 

(আমার কাছে রাখলে) আগুন লাগার ভয় নেই, পানিতে ডুবে যাবার আশংকা নেই, আর চুরি যাওয়ারও সুযোগ নেই। যেদিন তুমি এ সম্পদের সব থেকে বেশী মুখাপেক্ষী হবে সেদিন আমার কাছে রক্ষিত এ সঞ্চয় আমি তোমাকে পুরোপুরি ফিরিয়ে দেবো।” (তারগীব, তাবরানী)

উৎপন্ন ফসল ব্যবহারের নিয়ম

হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি মাঠ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মেঘের আড়াল থেকে কাউকে বলতে শোনলেন, ‘হে মেঘ, অমুক ব্যক্তির বাগানে গিয়ে পানি বর্ষণ করো।' তখন মেঘ সেদিকে চলে গেল এবং এক মাটি বিশিষ্ট পাহাড়ী জমিতে সমস্ত পানি ঢেলে দিল, ওখানে একটি নালা ছিল, সেটা সমস্ত পানি নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল। মুসাফির নালার পাশ দিয়ে পানির সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগলেন। 

কিছু দূর গিয়ে তিনি দেখলেন, এক ব্যক্তি নিজের বাগানে দাঁড়িয়ে পানি যাতে বাগানের গাছ পর্যন্ত যেতে পারে সে জন্য বেলচা দিয়ে পানির গতি পরিবর্তন করছে। তখন মুসাফির বাগানওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলের, ‘ওহে আল্লাহর বান্দা, আপনার নাম কি?' তিনি যে নামটি বললেন মেঘের মধ্যে থেকে অদৃশ্য আওয়াজেও এই নামটিই বলা হয়েছিল।

বাগানওয়ালা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনি আমাকে আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন কেন?' মুসাফির বললেন, 'আমি মেঘওয়ালাকে (আল্লাহকে) একথা বলতে শুনেছি, যাও, অমুক ব্যক্তির বাগানে গিয়ে পানি বর্ষণ করো। বলুন, আপনি এমন কি আমল করেন, যার জন্য আপনার উপর আল্লাহর এ রহমত বর্ষিত হলো?'

বাগানওয়ালা বললেন, 'যখন আপনি এ কথা জিজ্ঞেস করছেন এবং সবকিছু জেনেই ফেলেছন তখন আপনাকে বলছি, এই বাগান থেকে যা আমি পেয়ে থাকি তাকে আমি তিন ভাগে ভাগ করি। এক ভাগ আমি আল্লাহর নামে দিয়ে থাকি, এক ভাগ আমি ও আমার ছেলেমেয়েরা খাই এবং এক ভাগ এই বাগানের (জলসেচ এবং সার ইত্যাদিতে) ব্যয় করি।” (মুসলিম)

কোরআন পাঠের ফজিলত

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'নিঃসন্দেহে মানুষের মধ্যে কিছু আল্লাহওয়ালা লোক আছে।' লোকেরা বলল, “হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহওয়ালা লোক বলতে আপনি কাদের বুঝাচ্ছেন?'

তিনি বললেন, 'কোরআনওয়ালা লোকেরাই হলো আল্লাহওয়ালা এবং তাঁরা আল্লাহর বিশিষ্ট বান্দা। (নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)

  • ব্যাখ্যাঃ আহলুল কোরআন বলতে সে সব লোকদের বুঝায় যাদের কোরআনের প্রতি রয়েছে গভীর আকর্ষণ। তারা কোরআন পড়ে এবং পড়ায়, তার উপর চিন্তা গবেষণা করে এবং তার থেকে জীবন চলার পথ খুঁজে নেয়।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, “এ কোরআন আল্লাহর বিছানো দস্তরখানা। সুতরাং যতক্ষণ সামর্থ আছে আল্লাহর এ দস্তরখানে বসে থাকো। নিঃসন্দেহে এ কোরআন হলো আল্লাহর কাছে পৌঁছার) রশি এবং অন্ধকার দূর করার আলো। এ কোরআন কল্যাণের উৎসধারা এবং অসুস্থ রুগীর রোগ ভাল করার ঔষধ। 

যে সব লোক একে আঁকড়ে ধরে থাকবে তাদের জন্যে এ হবে রক্ষাকারী। যারা মান্যকারী তাদের জন্য এ হলো মুক্তির হাতিয়ার। এ কিতাব কারো প্রতি বিমুখ হয় না। ফলে একে রাজী করানোরও প্রয়োজন দেখা দেয় না। এ কিতাব বিশ্বয়কর মোজেযার অধিকারী। এর মোজেযা কখনও শেষ হয় না এবং বার বার পাঠ করলেও এ কিতাব কখনো পুরনো হয় না।” (তারগীব, মুসতাদরাক)

  • ব্যাখ্যাঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু কোরআনকে আল্লাহর দস্তরখান বলে বর্ণনা করে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। দেহের খোরাক না দিলে যেমন দেহ টিকে থাকতে পারে না তেমনি অন্তরের খোরাক না দিলে মনের সুকুমার বৃত্তিগুলোর ও মৃত্যু ঘটে। 
  • দেহের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আল্লাহ যেমন আহারের ব্যবস্থা করেছেন তেমনি তিনি মানুষের রুহানী অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নিজের হেদায়াত দিয়ে পাঠিয়েছেন কোরআন। এ দস্তরখানে না বসলে নিজের আত্মার খোরাক পাওয়া যাবে না। মানুষ তার হৃদয়কে যত বেশী মানবিক ও উন্নত করতে চাইবে কোরআনের সাথে তার তত বেশী সম্পর্ক বৃদ্ধি ও ঘনিষ্ট করতে হবে।

‘এ কোরআন হলো আল্লাহর রশি'-এর অর্থ হলো, রশির সাহায্যে যেমন কুয়ো থেকে পানি তুলে পিপাসা নিবারণ করা যায় তেমনি কেউ আল্লাহর কাছে পৌঁছতে চাইলে কোরআনের মাধ্যমেই তার এ আকাংখা ও পিপাসা মিটানো সম্ভব। কেউ আল্লাহর সান্নিধ্যে যেতে চাইলে এ রশি ধরেই তাকে অগ্রসর হতে হবে, পথ চলতে হবে।

কোরআনকে ‘আলো’ বলা হয়েছে। আর আলো হলো এমন জিনিস যা অন্ধকারকে দূর করে দেয়। এ কিতাব এমন এক আলো যা পার্থিব জীবন-পথের সকল অন্ধকার দূর করে আল্লাহর কাছে পৌঁছার শাহী সড়কের সকল প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে দেয়। এ দুনিয়া হলো অন্ধকারময়। এতে প্রতি পদক্ষেপে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। যে ব্যক্তি এ আলোকে সঙ্গে নেবে না সে কোন না কোন গহ্বরের মধ্যে পড়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।

এ কিতাব মানুষের অন্তরের রোগকে দূর করে দেয়। এর বিস্ময়কর মোজেযার ভান্ডার কখনও শেষ হবার নয়। এটা কোন পোষাক নয় যে, ইচ্ছে করলে তা শরীর থেকে খুলে ফেলা যাবে বা বেশী ব্যবহার করলে পুরাতন হয়ে যাবে। বরং একে যত বেশী ব্যবহার করা হবে ততই তার ঔজ্জ্বল্য ও নতুনত্বে চমৎকৃত হতে হবে।

পোস্ট ট্যাগঃ

দানের হাদিস
মসজিদে দানের হাদিস
কোরআন হাদিসের আলোকে দানের ফজিলত
দানের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস
দানের ফজিলত হাদিস
কোরআন ও হাদিসের আলোকে দানের ফজিলত
দানের আয়াত ও হাদিস
দানের হাদীস
দানের আরবি হাদিস
দানিয়াল নবীর ঘটনা
হাদিস-কোরআনের কথা

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url