সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন

সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন

সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন

হযরত কা'আব বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে আমাদের তিন জনের সঙ্গে 

(অর্থাৎ আমারহেলাল ইবনে উমাইয়া এবং ইবনে রবী'আর সঙ্গে) কথাবার্তা বলতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। কারণ আমরা তাবুক যুদ্ধের সময় অলসতাবশতঃ যেতে পারিনি। 

তাই সকলে আমাদের সঙ্গে মেলামেশা ছেড়ে দেয় এবং তারা এমন ভাবে পাল্টে যায় যে, যেন তারা আমাদের চেনেই না। এমনকি মদীনার মাটি আমাদের জন্যে অচেনা হয়ে গিয়েছিল। এই মদীনা সে মদীনা ছিল না যাকে আমরা জানতাম। এমতাবস্থায় পঞ্চাশ রাত কেটে যায়।

আমার দুই সঙ্গীর (হেলাল ইবনে উমাইয়া মুরারা ইবনে রবীর) ওপর এই বয়কটের অত্যন্ত প্রভাব পড়ে। তারা নিজেদের ঘরে বসে কাঁদতে থাকে। আর আমি যেহেতু যুবক ছিলাম আমার হৃদয় দৃঢ় ছিল সেহেতু আমি ঘরের বাইরে আসতাম, মুসলামনদের সঙ্গে নামাযে যোগ দিতাম এবং বাজারে ঘোরাফেরা করতাম; কিন্তু কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতো না।

হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নামায পড়া শেষ করে মসজিদে নববীতে বসতেন তখন আমি তাঁর কাছে যেতাম এবং সালাম করতাম, আর তারপর মনে মনে চিন্তা করতাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সালামের জবাব দিলেন কি না। 

আবার আমি তাঁর নিকটবর্তী হয়ে নামায পড়তাম এবং চুপি চুপি তাঁর দিকে তাকাতাম। যখন আমি নামায পড়তে থাকতাম তখন তিনি আমাকে দেখতেন, আর যখন আমি তাঁর দিকে তাকাতাম তিনি তখন মুখ ফিরিয়ে নিতেন। 

এভাবে যখন মুসলামনদের বিমুখতা খুব বেশী দুঃসহনীয় হয়ে ওঠে তখন আমি আবু কাতাদার বাগানের পাঁচিল টপকে আবু কাতাদার কাছে পৌঁছাই। সে আমার চাচাত ভাই এবং অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। আমি তাকে সালাম দিই কিন্তু সে তার জবাব দিল না।

আমি তাকে বলি, 'হে আবু কাতাদা; আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি। আমি আল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসি, তা কি তুমি জানো না? কিন্তু সে যথারীতি নির্বাক থাকে। তারপর আমি দ্বিতীয়বার আল্লাহর কসম দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করি, তবুও সে চুপ থাকে। আমি তৃতীয়বার আল্লাহর কসম দিয়ে তাকে আবার কথা জিজ্ঞেস করি।

তখন সে বলে, ‘আল্লাহ এবং রাসূল জানেন (তুমি আল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাস কি না, তাঁদের কাছ থেকে এর সার্টিফিকেট নাও) কথায় আমার চোখ দিয়ে অশ্রু বেরিয়ে পড়ে। আমি দেয়াল টপকে ফিরে যাই।” (বোখারী মুসলিম)

  • ব্যাখ্যা: এটা জামায়াতী নিয়ম-শৃঙ্খলার এক অতি উৎকৃষ্ট নমুনা। যখন আল্লাহর আদেশে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা'আব বিন মালিক তাঁর উপরোল্লিখিত দুই সঙ্গীকে বর্জনের ঘোষণা করেন এবং সবাইকে তাঁদের সঙ্গে কথা বলা থেকে বিরত রাখেন তখন সমগ্র মদীনা তাদের জন্য এক অচেনা অজানা নগরীতে পরিণত হয়ে যায়। 
  • এমনকি তাঁর অতি অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং চাচাত ভাই আবু কাতাদাও গোপনে আল্লাহর কসম দেয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে কথা বলেন না। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করে দিয়েছিলেন। এই জামায়াতী নিয়ম শৃঙ্খলা সম্পর্কে আরো বেশী জানতে হলে তাফহীমুল কোরআনের দ্বিতীয় খন্ডে সূরা তাওবার ১১৯ নং পাদটীকা দেখুন।

দানের ফজিলত ঘটনা

হযরত আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “আমি হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হযরত আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা (আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর খালা মা) অপেক্ষা অধিক দাতা মহিলা দেখিনি। তাঁদের দু'জনের দান দুই রকমের ছিল।

হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুর অবস্থা ছিল, তিনি প্রতিদিন কিছু না কিছু জমা করতে থাকতেন এবং যখন তা বেশ কিছু পরিমাণ হয়ে যেতো তখন তা গরীবদের মধ্যে বন্টন করে দিতেন।

আর আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহুর অবস্থা ছিল, তিনি প্রতিদিনই যা কিছু পেতেন তা অভাবী লোকদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন এবং আগামী কালের জন্যে কিছুই রাখতেন না।”

সম্পত্তি যখন বিপদের কারণ

এক আনসারী নিজের কোন এক বাগানে নামায পড়ছিলেন। এই বাগান মদীনার বিখ্যাত উপত্যকা 'কৃষ্ণ'-এর মধ্যে ছিল। খেজুর গাছ ফলে পরিপূর্ণ ছিল। নামায পড়ার সময় তাঁর দৃষ্টি সেই ফলের দিকে যায় এবং তাতে তিনি আনন্দবোধ করেন। পুনরায় তিনি নামাযের দিকে দৃষ্টি দেন কিন্তু কত রাকাত পড়েছেন, তা বিস্তৃত ভুলে যান।

তখন তিনি চিন্তা করেন, আমার এই সম্পত্তি তো আমার জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর তিনি খলীফা হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁর কাছে সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, 'আমি আমার এই বাগানকে ওয়াক্ফ করে দিলাম। আপনি এটাকে নেকীর কাজের লাগান।'

হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু সেই বাগান পঞ্চাশ হাজার দিরহামে বিক্রি করে দেন এবং নাম রাখেন খামসীন।”

আল্লাহর রাস্তায় দান করার ফজিলত

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “আবু তালহা আনসারী মদীনার সব থেকে ধনবান ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর যত খেজুরের বাগান ছিল অন্য কারো তা ছিল না। 'বায়রুহা' বাগান তাঁর সব থেকে ভাল প্রিয় বাগান ছিল। এই বাগান মসজিদে নববীর সামনে ছিল। 

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বাগানে যেতেন পানি খেতেন। এই বাগানের কুয়ার পানি ছিল অতি উত্তম।

তোমরা কখনোই পূণ্য লা করতে পারবে না, যতোক্ষণ না নিজেদের প্রিয় মাল আল্লাহর রাস্তায় খরচ করো।' (আলে ইমরান- আয়াত-৯২

যখন অবতীর্ণ হয় তখন আবু তালহা রাদিয়াল্লাহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে বলেন, হে রাসূলুল্লাহ! আল্লাহতায়ালা বলেছেন, 'তোমরা কখনোই পূণ্য লাভ করতে পারবে না, যতোক্ষণ না নিজেদের প্রিয় মাল আল্লাহর রাস্তায় খরচ করো।'

বায়রুহাআমার সব থেকে প্রিয় সম্পদ। আমি এটাকে আল্লাহর রাস্তায় ওয়াক্ফ করে দিলাম যাতে আল্লাহর কাছে এটা আমার জন্য জমা থাকে। সুতরাং এটা আপনি আপনার রব যেভাবে বলেন সেভাবে ব্যয় করুন।'

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'সাবাশ! তুমি খুবই ভাল কাজ করেছো। এটা হলো লাভজনক ব্যবসা, খুবই লাভজনক ব্যবসা।” (বোখারী মুসলিম)

অধিক দানকারীকে আল্লাহ অধিক সম্পদশালী বানিয়ে দেন

হযরত কায়েস ইবনে সিলা আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, “তাঁর ভাইয়েরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, তিনি তাঁর ধন-সম্পদ লুটিয়ে দেন এবং খুব বেশী দান করেন।'

আমি বলি, 'হে রাসূলুল্লাহ। আমি আমার নিজের অংশের খেজুর নিয়ে নিই এবং তা আল্লাহর রাস্তায় আমার সঙ্গী-সাথীদের জন্যে খরচ করি।' তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার বুক চাপড়ে উৎসাহের সঙ্গে বললেন, 'খরচ করো, আল্লাহতায়ালা তোমাকে দেবে।' কথা তিনি তিনবার বলেন।

এখন আমার অবস্থা এমন যে, আমি আমার, উটনীতে চড়ে জিহাদ করতে যাই। আর আজ আমি আমার গোত্রের মধ্যে সব থেকে অধিক সম্পদশালী সচ্ছল।” (তারগীব তাবরানী)

দাতা গ্রহীতা উভয়েই কখন পুরস্কারের অধিকারী হয়

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “একবার মুহাজিরগণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, 'আনসারগণ সমস্ত পুরস্কার হাতিয়ে নিল। এরা প্রচুর সম্পদ ব্যয় করছে। যার কাছে অল্প পরিমাণ আছে সেও নিজের সামান্য সম্পদ থেকে গরীবকে অংশীদার করে নিজের পাল্লা ভারী করে নিচ্ছে। আমাদের সমস্ত খরচ তো এরা আপন দায়িত্বে নিয়ে নিয়েছে।'

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'তোমরা কি এদের জন্যে শোকরের মনোভাব রাখো না? তোমরা কি এদের জন্য দোয়া করো না?' মুহাজিরগণ বলেন, 'হ্যাঁ, আমরা এদের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং এদের জন্যে দোয়া করি।'

তিনি বললেন, ‘এটাই তার প্রতিদান। ওরা তোমাদের ওপর অনুগ্রহ দেখাচ্ছে আর তোমরাও তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করছো। তোমরাও পুরস্কারের অধিকারী আর ওরাও পুরস্কারের অধিকারী” (আবু দাউদ নাসাঈ)

পোস্ট ট্যাগঃ

সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন
সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন pdf
সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন pdf download
সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন ১ম খন্ড
সাহাবীদের ঈমানদীপ্ত জীবনী
সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবনী pdf
সাহাবাদের ঈমানদীপ্ত জীবন
সাহাবীদের ঈমান কেমন ছিল
সাহাবায়ে কেরামের ঈমান
সাহাবায়ে কেরামের ত্যাগ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url