ডারউইন এর মতবাদ

 ডারউইন এর মতবাদ

ডারউইন এর মতবাদ
অতীত ও বর্তমান চিন্তা

খ্রীষ্টজন্মের বহু শতক আগে থেকেই গ্রীক দার্শনিকগণ বিশ্বাস করতেন যে, জীবন্ত সব কিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া রয়েছে। তাদের এ চিন্তা নেহায়েত দার্শনিক পর্যায়ের ধারণা। এদের ধারণা কিছু কিছু সত্য প্রমাণিত হলেও তাদের অন্যান্য ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় তাদের কোন ধারণারই তেমন মূল্য ছিল না। তারপর প্রকৃতি বিজ্ঞানী লামার্ক বিবর্তন সম্পর্কে ১৮০১ সালের দিকে প্রথম যে বইটি লেখেন তার নাম “ইনোগুর‍্যাল স্পীচ”। এর আট বছর পর তিনি লেখেন 

“জুওলজিক্যাল ফিলোসফি” 

নামক আর একটি গ্রন্থ। এরপর ১৮২২ সালের দিকে প্রকৃতি বিজ্ঞানী কভিয়ার বিবর্তন সম্পর্কে একটি পুস্তক রচনা করেন- যার নাম “হিস্টরি অব ফসিলাইজড বোনস”। তিনি এ পুস্তকে বর্তমান ও অতীতের প্রাণীসমূহের দেহাস্থির তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। তবে

কভিয়ারের গবেষণা বিবর্তন

সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা দিতে পারেনি। পরবর্তী কালে বাফুন নামক একজন চিন্তাবিদ, জীবজগতের বিভিন্ন প্রজাতি একটি মূল প্রজাতির থেকে উদ্ভব হওয়ার কথা চিন্তা করেন।

তার ধারণা ছিল প্রতিটি জীব প্রজাতি সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে ভিন্ন ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। তবে তিনি দৈহিক কাঠামোর রূপান্তর হওয়ার বিষয়টি বিশ্বাস করতেন না। অপরদিকে লামার্কের মতে- পরিবেশগত পরিবর্তনে যখন কোন প্রজাতির জীবন ধারা বদলে যায় তখন সে প্রজাতির আকারে, গড়নে, বিভিন্ন প্রতঙ্গের অনুপাতে, রঙ্গে, দৃঢ়তায়, ক্ষিপ্রতায়, 

এমন কি সে প্রজাতির অধ্যাবসায়, ক্ষমতায়ও পরিবর্তন দেখা দিতে পারে এবং সে প্রজাতির মাঝে নতুন চাহিদাও সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে (অভ্যাসের দরুন) তাদের দেহের কোন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকতর ব্যবহার ঘটতে পারে, আবার কোন কোন প্রতঙ্গ উপেক্ষিত হতে পারে। এর ফলে অব্যবহৃত অঙ্গ সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে অথবা

অব্যবহৃত অঙ্গটির বিলুপ্তিও ঘটতে পারে। কিন্তু বর্তমানে পরিবেশগত প্রভাবের দরুন কোন জীবের গঠন ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার পরবর্তী বংশধারায় সঞ্চারিত হওয়ার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। 

তবে পরিবেশগত প্রভাবে কোন অঙ্গের দৈহিক ক্ষমতা কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে কিন্তু তা বংশানুক্রমিক সঞ্চারিত হয় না। তারপর ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচন সংক্রান্ত মতবাদ দিয়ে ১৮৫৯ সালে প্রকাশ করেন অন দি অরিজিন অব স্পেসিস” নামক একটি পুস্তক।

ডারউইন

চিন্তা করেছিলেন পৃথিবীর আদি এককোষী প্রাণীর বংশানুক্রমিক ধারা দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ।

অ্যামিবা

হলো সাগরের আদি এককোষী প্রাণী। এদের থেকেই শুরু হয়েছে উদ্ভিদ ও প্রাণীর ক্রমবিকাশ। তিনি ভেবে ছিলেন জীবের ধারাবাহিক আঙ্গিক পরিবর্তন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থাকার অভিব্যক্তির প্রকাশ মাত্ৰ। 

যেমন পানির মাছ ডাঙ্গার পড়ে বুকে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাত পা প্রভৃতি গজিয়ে উঠলে তারা উভচর ও সরীসৃপে রূপ নেয়। খাবি খেতে খেতে জলজ প্রাণীর ফুলকা স্থলচর প্রাণীর ফুসফুসে রূপান্তরিত হয়। পরিবেশের জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার চেষ্টা প্রসূত অর্জন ভিত্তিক ক্রম বিকাশের নাম বিবর্তনবাদ

ডারউইন জীবন

সংগ্রামে টিকে থাকাকে বলেছেন- যোগ্যতমের উর্দ্ধতন। জীবন সংগ্রামে জীবগুলো যে সমস্ত গুণ অর্জন করে তার ধারা বংশগতির মাধ্যমে উত্তরাধিকারগণের মাঝে সংক্রামিত হয়। তিনি চিন্তা করেছিলেন পরিবেশের পরিবর্তনের জন্য প্রাণী জগতের প্রজনন কোষসমূহের আকৃতির পরিবর্তন ঘটে থাকে এবং এর ফলে গুণগত যে পরিবর্তন সাধিত হয় তা বংশানুক্রমে সঞ্চারিত হয়। 

তার কথা হলো দুর্বলদের বিনাশ ঘটে এবং সবলরা পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকে। প্রয়োজনে এরা তাদের আঙ্গিক পরিবর্তন ঘটাতেও বাধ্য থাকে। যা পরবর্তী বংশানুক্রমেও সঞ্চারিত হয়। এতে দেখা যায়

ডারউইন সব সময়ই জীবজগতের বিবর্তনের

চিন্তায় পরিবেশের প্রাধান্যকেই বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি কখনো বিবর্তনের ক্ষেত্রে স্রষ্টার হাত আছে, এ কথা চিন্তা করেননি। কিন্তু পরিবেশের চাপে যে সব কিছুর পরিবর্তন হয় না, তা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমেও প্রমাণিত হয়েছে।

প্রকৃতির মাধ্যমে যোগ্যতমের নির্বাচন নীতিকে তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচন বলেছেন। তার মতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে একটি প্রজাতি অন্য একটি প্রজাতিতে রূপ নেয়। কালক্রমে প্রাণী ও উদ্ভিদের বংশগতির ধারা ধাপে ধাপে বিকাশ লাভ করেছে। অপরদিকে নিম্ন শ্রেণীর উদ্ভিদের ক্রমবিকাশ ধারা গিয়ে ঠেকেছে জটিল সপুষ্পক উদ্ভিদে। 

আর নিম্ন শ্রেণীর জীব প্রজাতি পর্যন্ত বানরে উন্নীত হয়ে মানুষে রূপ নিয়েছে। কিন্তু ডারউইনের বিবর্তনবাদ শেষ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিগৃহীত হয়েছে। তাই বিজ্ঞানীগণ এখন উদ্দেশ্যমুখী বিবর্তনের কথা ভাবছেন । 

তবে এই বিবর্তনের ধারা যে কি, সেটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আমি এ ব্যাপারে কোরআন থেকে যে তথ্য খুঁজে পেয়েছি তার আলোকে বলছি, ডারউইনের বিবর্তনবাদ ও উদ্দেশ্যমুখী বিবর্তনবাদের তফাৎটি হলো-ডারউইন জীবের আঙ্গিক পরিবর্তনের ব্যাপারটি জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার অভিপ্রায় হিসেবে মনে করতেন। 

তার ধারণা ছিল-মানুষ যেভাবে ক্রস-ব্রিডিং পদ্ধতিতে উন্নতর জাতের পশু উৎপাদন করতে পারে, তেমনি প্রকৃতি রাজ্যে জীবকুলের উন্নয়নের জন্য এমনি কোন প্রাকৃতিক পদ্ধতি বিদ্যমান আছে। কিন্তু স্রষ্টার উদ্দেশ্যমুখী সাংগঠনিক বিবর্তন পদ্ধতির রীতিতে জীবের আঙ্গিক পরিবর্তন ও নতুন প্রজাতির উদ্ভব হওয়া এসবই স্রষ্টার অভিপ্রায়ের ওপরই নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে স্রষ্টার নির্দেশে তথ্য কণার পরিবর্তন ও সংযোজনের মাধ্যমেই নতুনের উদ্ভব ঘটেছে।

আল-কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন- “আল্লাহই প্রত্যেক জিনিসকে এর আকার ও প্রকৃতি দান করেছেন।” (সূরা ত্বহা আয়াত ৫০)

আল্লাহর সৃষ্টি

প্রক্রিয়াতে দৈবের কোন আশ্রয় নেই। সব কিছুতে রয়েছে বৈজ্ঞানিক কৌশল। একটা বানর দাঁড়িয়ে আছে আর আল্লাহ বলে দিলেন, মানুষ হয়ে যা, এতেই বানরটি মানুষ হয়ে গেল; এভাবে পয়দা করার কোন নীতি আল্লাহ তায়ালা অবলম্বন করেননি।

কিংবা বিভিন্ন স্থানের মাটি আনিয়ে মূর্তি বানানোর পর বললেন, মানুষ হয়ে যা, এভাবেও সৃষ্টি করেছেন, এর কোন প্রমাণ নেই। বরং এমন করেছেন যেমন-মা আছে পিতা নেই। তবু বলে দিয়েছেন, ঐ মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান হোক। এ ক্ষেত্রে

পিতার স্পর্শ ছাড়াই মাতৃগর্ভ

থেকে সন্তান হওয়ার প্রমাণ আছে। কিন্তু এখানেও মা দ্বৈব ক্রমে গর্ভবতী হয়নি। বরং এ ক্ষেত্রে মাটি ও পানির উপাদান দিয়ে আল্লাহর হুকুমেই শুক্রাণু সৃষ্টি হয়ে তা ঐ মার ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার পরই তার গর্ভ থেকে সন্তান হয়েছে। আবার দু'টি ভিন্ন গঠনের (একই গোত্রভুক্ত) প্রাণীর প্রজননের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে।

এমনকি মানুষের গর্ভ থেকেও ভিন্ন আকৃতির প্রাণীর জন্ম হওয়ার কথা শুনা যায়। সকল ক্ষেত্রে প্রাণী ও উদ্ভিদের বিচিত্র গঠন ও বৈশিষ্ট্য স্রষ্টার ইচ্ছার ওপরই নির্ভরশীল। স্রষ্টার ইচ্ছামাফিক আঙ্গিক পরিবর্তনের জন্য যে সব তথ্য প্রেরণ করেছেন- এর থেকেই প্রাণীর বিচিত্র ধরনের আকার সৃষ্টি হয়েছে। তাই প্রতিটি প্রাণী হলো তথ্য কণার ভাণ্ডার। 

স্রষ্টা থেকে তথ্য প্রেরীত হয় তরঙ্গের মাধ্যমে। ফলে মূল জিনিসটির একত্রে নাম হবে তথ্য- তরঙ্গ বা তথ্যকণা কিংবা তথ্য কাঠামো। আর মূল প্রাণীটি হবে অগণিত তথ্য কণার সাজানো সারি। যিনি অসংখ্য তথ্য দিয়ে প্রতিটি জীবকে আকার-আকৃতি ও স্বভাব দান করেছেন তিনিই আমাদের সকলের পালন কর্তা। তাঁর উদ্দেশ্যমুখী সাংগঠনিক বিবর্তন ধারার চূড়ান্ত রূপ হলো 'আদমের আবির্ভাব। তার মাধ্যমেই জগতের সকল মানুষের উৎপত্তি। এ ধরনের বিবর্তন আল-কোরআনের মাধ্যমেও স্বীকৃত।

জীবের আদি উৎসের

সাথে পানির সম্পর্ক যখন কোন কিছুর শুরু নিয়ে চিন্তা করা হয় তখন ভাবা হয় ঐ জিনিসটা কিভাবে তৈরী হলো? কি উপাদান দিয়ে তৈরী করা হয়েছেকোথায়কখন হয়েছেকে বানিয়েছেনইত্যাদি ইত্যাদি।কিন্তু এত সব প্রশ্নের উত্তর যে আমরা দিতে পারব এমন নিশ্চয়তা দেয়া যায় না।আমরা জীব প্রজাতির অংশ হিসেবে জীবের আদি উৎস সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। 

কারণ পৃথিবীতে মানব প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছে সৃষ্টির সূচনার কোটি কোটি বছর পর। সেজন্য আমাদেরকে অনেক ক্ষেত্রে অনুমানের ওপর নির্ভরশীল হতে হয় । তাই আমাদের অনুমান হয় আপেক্ষিক। এটা স্থান- কালের পরিসরে কখনো সত্য হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।

জগতের সকল কিছু কে বানাল?

এ প্রশ্নের জবাব বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত। কারণ যিনি এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন, তাকে সাধারণ মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব নয় বিধায় বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে চলতে থাকলে শেষ পর্যায়ে এমন এক সত্তার সন্ধান পাওয়া যায় যিনি চিরন্তন সত্তা। তিনিই জগতের সকল কিছুর সৃষ্টি করেছেন। আমরা যাঁকে জগতের চিরন্তন সত্তা হিসেবে পেলাম তিনিই পরম প্রতিপালক আল্লাহ ।

আল্লাহ কোরআনে ঘোষণা করেছেন- “আল্লাহ সৃষ্টিধারা প্রবর্তন করেন তারপর পুনারাবৃত্তি করেন।” (৩০: ২৭) আল্লাহ তা'য়ালা জগতের সকল জীব, উদ্ভিদ, বস্তু ও বস্তুর উপাদানের স্রষ্টা। তিনি সৃষ্টির সূচনা ও পুনঃসৃষ্টি প্রবর্তন করেন। সকল সৃষ্টির ক্ষেত্রেই সৃষ্টির মূল উপাদান, স্থান-কাল ও অনুকুল পরিবেশ জড়িত রয়েছে। কোন জীবকেই আকাশ থেকে মাটিতে ফেলে দেয়া হয়নি। সে হিসেবে পানিই হলো জীবের আদি উৎস। এটা যেমন বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত তেমনি আল-

কোরআনেও উদ্ধৃত হয়েছে ১৪০০ বছর আগে। তাই পানির সাথে জীবের আদি উৎসের সম্পর্ক রয়েছে।

আল্লাহ বলেন “আল্লাহ সমস্ত প্রকারের প্রাণীকে সৃষ্টি করেছেন পানি হতে।” (সূরা আন নূর আয়াত ৪৫)

“(আল্লাহ) সেই একক সত্তা যিনি মানুষকে পানি থেকে গঠন করেছেন এবং প্রতিষ্ঠিত করেছেন বংশধারা (পুরুষের মাধ্যমে) এবং আত্মীয়তার ধারা নারীদের মাধ্যমে।” (সূরা ফুরকান আয়াত ৫৪ )

“অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী একত্রে মিলিত ছিল? পরে আমরা তাদের পৃথক করেছি এবং আমরা প্রতিটি জীবন্ত জিনিসকে বের করেছি পানি থেকে? তার পরও কি তারা বিশ্বাস করবে না? (সূরা আম্বিয়া আয়াত ৩০)

আল্লাহ তায়ালার বাণী থেকে আমরা এই ধারণাই নিতে পারি যে, সৃষ্টির প্রতিটি জীবন্ত জিনিসের অপরিহার্য উপাদান পানিতেই ছিল এবং পানি থেকেই মানুষসহ জীবন্ত সকল কিছুর উৎপত্তি ঘটেছে। সেই হিসেবে মানুষের আদি উৎস হলো পানি। কিন্তু মানুষ পানিতে বাস করে না। তাদের আবাসস্থল হলো স্থলভাগ। কিন্তু পানিতে যাদের আদি উৎস তারা স্থলভাগে এলো কি করে? এর জবাবে বলা যায়, স্রষ্টার উদ্দেশ্যমুখী সাংগঠনিক বিবর্তন ধারাই এর প্রকৃত মাধ্যম।

পানির জীব

ডাঙ্গায় বাস করলেও দেখা যায় ডাঙ্গার জীবের দেহ কোষে রয়েছে ৭০ ভাগ পানি। পানি ছাড়া জীবন ধারণ অসম্ভব। বিজ্ঞানীগণ গ্রহান্তরে জীবনের (প্রাণের) সন্ধান করতে গিয়ে প্রথমেই খুঁজেছেন পানির অস্তিত্ব। 

কারণ পানি হলো জীবনের অপরিহার্য উপাদান। তাই অনুসন্ধান করে দেখা গেছে পৃথিবীতে আদিতে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে পানি থেকেই। পৃথিবীর আদি এককোষী অ্যামিবার উৎপত্তি হয় সাগরের লোনা পানিতে। তার গঠন প্রকৃতি আশ্চর্যজনক ও রহস্যময় এবং জটিল। এর মধ্যে রয়েছে প্রোটোপ্লাজম ও নিউক্লিয়াস। এদের রাসায়নিক গঠনও জটিল। আবার

নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজমের

একটি অংশ হলো 'জিন'। এর মাধ্যমেই লুকিয়ে থাকে বংশগতির গোপন তথ্য। জীবকোষের বেশীর ভাগ অংশই পানি এবং বাকি অল্প কিছু থাকে গ্যাসীয় উপাদান। এদের দিয়ে গঠিত জীবকোষের প্রোটোপ্লাজম নামক অতি জটিল জৈব রাসায়নিক পদার্থটির কর্ম চাঞ্চল্যই জীবনকে গতিময় করে রাখে। জীবকোষের অভ্যন্তরে জীবন নামের একটা স্পন্দন বিরাজ করে। 

সুস্থ প্রাণীর হৃৎপিণ্ড যেমন নিজের থেকেই স্পন্দিত হতে থাকে তেমনি জীবকোষের মৌল ও যৌগের অনুপাত এবং অনুকুল পরিবেশ টিকে থাকলে নিজে থেকেই সেটি স্পন্দিত হতে থাকে। একটা কলেরার রোগীর শরীরের জলীয় অংশ (লবন পানি) বের হয়ে গেলে হৃৎপিণ্ড সতেজ থাকলেও সেটির স্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়।

তেমনি জীবকোষের অভ্যন্তরীণ

পানি ও অন্যান্য উপাদানের আনুপাতিক সাম্যতা বজায় না থাকলে সেটিতে স্পন্দন বা প্রাণের অস্তিত্ব খুব পাওয়া যাবে না। এখানে স্পন্দন হলো স্রষ্টার Information bit, এটিই জীব নামের রহস্যময় সত্তা। একে পৃথিবীতে ধরে রাখার উপযুক্ত মাধ্যম হলো পানি।

একটা ক্যাসেটের ফিতায় যেমন-বিভিন্ন সঙ্গীত ধারণ করে রাখা হয়, তেমনি পানি হলো পৃথিবীতে জীবনকে (Information bit) বন্দি করে রাখার মূল উপাদান। সেটা যেমন পানির জীবের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য তেমনি ডাঙ্গার জীবের ক্ষেত্রেও সমভাবে কার্যকরী। তাই পানির অপর নাম বলা হয় জীবন।

অর্থাৎ জীবনকে পৃথিবীতে ধারণ করে রাখার জন্য পানি হলো মূল উপাদান। সেটা পানি কিংবা ডাঙ্গার জীবের ক্ষেত্রে সমভাবেই কার্যকরী। তাই ডাঙ্গার জীবের আদি উৎস হলো পানি। অর্থাৎ ডাঙ্গার জীবের প্রাণ সত্তাকে ধরে রাখার জন্য তার উৎপত্তি ঘটানো হয়েছে পানি থেকেই। তাই পানির সাথে পানির ও স্থলের জীবের সম্পর্ক খুব নিবীড়।

পানির জীব ও স্থলের জীবের সম্পর্ক

পানির জীব পানিতে জন্ম হয়েছে, একথা আমরা সহজেই মেনে নেই। আবার যদি বলা হয় স্থলের জীবের আদি উৎস হলো পানি, তখন কি আমরা তা সহজেই বিশ্বাস করি? সত্যিকার অর্থে দেখা যায় একথাটি আমরা সহজে বিশ্বাস করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাই। কিন্তু যখনি এর পেছনে নির্ভুল যুক্তি পেশ করা হয় তখন বিশ্বাস করতে কোন বাধা থাকে না। 

কার্যতঃ দেখা যায় স্থলের জীবের জীবকোষ আর পানির জীবের জীব কোষের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। যদি এমন হতো যে, স্থলের জীবের জীবকোষে পানি নেই, তবে আমরা বলতে পারতাম যে স্থলের জীব স্থলেই জন্ম হয়েছে, কিন্তু স্থলের জীবের জীব কোষে যেহেতু পানি রয়েছে, সুতরাং বলা যায় এদের বংশগতির ধারা পানি থেকেই শুরু হয়েছে। 

পানির জীব ও স্থলের জীবের মধ্যে সম্পর্ক হলো উভয়ের জীবকোষের গঠন ও কার্যপ্রণালী প্রায় একই। তবে স্থলের জীবের জীবকোষে রয়েছে ৭০ ভাগ পানি আর পানির জীবের জীবকোষে ৯৮ ভাগ পানি। এছাড়া অন্যান্য সকল দিক থেকে উভয়ের পরিমাপে কোন তফাৎ নেই।

পৃথিবীর সমস্ত জীবের

আদি উৎস যে পানি থেকে হয়েছে তা আল কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে বিদ্যমান রয়েছে।

সব জীবকে আল্লাহ পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন; এদের কোনটি হামাগুড়ি দিয়ে চলে; কোনটি চলে দু'পায়ে আর কোনটি চলে চার পায়ে।” (সূরা আন নূর আয়াত ৪৫)

পানি থেকে যে জীবের উদ্ভব হয়েছে, সেটি স্থলে এলো কিভাবে? এ প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয়। পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে তাদের আবাসস্থল অনুযায়ী এদেরকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন জলচর প্রাণী, উভচর প্রাণী এবং স্থলচর প্রাণী। এখানে দেখা যায় পানির জীব ডাঙ্গায় উঠে থাকতে পারে না। আবার স্থলের জীব পানিতে ডুবলে মারা যায়। অপরদিকে উভচর প্রাণী জলে ও স্থলে উভয় স্থানে বাস করতে পারে।

পানি ও উভচর প্রাণীর জীবকোষের মধ্যে খুব তফাৎ না থাকলেও অঙ্গের দিক থেকে অনেকটা তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। যেমন পানির জীবের পা নেই বললেই চলে কিন্তু উভচর জীবের হাত, পা আছে । আবার স্থলের প্রাণীরও হাত-পা আছে। এখানে দেখা যায় উভচর ও স্থলের প্রাণীর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম মিল রয়েছে।

মূলত পৃথিবীতে প্রত্যেক প্রজাতির প্রথমে আদি বংশধারা প্রবর্তিত হয়। তারপর সেই সৃষ্টিরধারা থেকে বংশগতির ধারার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। যেমন অ্যামিবা বা এককোষী প্রাণীর বংশগতির তথ্য যেমন জিনগুলো বহন করে তেমনি বহুকোষী প্রাণী বা স্থলের জীবের বংশগতির তথ্যও জিনেরাই বহন করে। পর্যায়ক্রমে বা ধাপে ধাপে সৃষ্টির সাংগঠনিক

বিবর্তন

ধারায় পৃথিবীর প্রথম প্রজাতির বংশধর বহুকোষী প্রাণীতে রূপ নিলেও পানির জীব পানিতে বাস করতে থাকে । ধারণা করা যায় অতীতে বিবর্তনের ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম সাংগঠনিক রীতি কাজ করেছে। এ পদ্ধতিতে বার বার পুরাতন প্রজাতি থেকে জিন রূপান্তরের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়। 

অর্থাৎ প্রকৃতিতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে জিন রূপান্তরের মাধ্যমে সেখানে নতুন তথ্য কণার সংযোজন করা হলে পানির জীব থেকে উভচর জীবের বাচ্চা প্রসব হয়। অতঃপর আবার প্রকৃতিতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে উভচর জীবের ক্ষেত্রেও জিন রূপান্তর ঘটে। 

ফলে উভচর জীবের বাচ্চা পানিতে বাস করার অনকূল অঙ্গ হারিয়ে ফেলে এবং ডাঙ্গায় বাস করার মতো উপযোগী অঙ্গ লাভ করে। এক্ষেত্রে প্রতি ধাপে ধাপেই অনুকূল পরিবেশের জন্য অনেক অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। অতঃপর এভাবেই বিবর্তনের মাধ্যমে পানির জীব থেকে ডাঙ্গার জীবের উদ্ভব ঘটেছে। এখানে স্রষ্টার মহতী ইচ্ছাতেই জিন রূপান্তর ঘটেছে। 

যখনি স্রষ্টা এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভব ঘটিয়েছেন তখন সৃষ্টি প্রক্রিয়ার “তিন নম্বর” রীতি কাজে লাগিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ায় পিতার সংস্পর্শ ছাড়াই মাতৃগর্ভ থেকে নতুনের উদ্ভব ঘটিয়েছেন। তাই পানির জীবের 'জিন' যে তথ্য বহন করেছিল, সেগুলো এখনো ডাঙ্গার জীবের জিন বহন করে আসছে।

তাই দেখা যায় শারীরিক কাঠামো

যত ভিন্নই হোক না কেন তবু কোন না কোন দিক থেকে পানির জীবের সাথে উভচর ও স্থলের জীবের মিল রয়েছে। যদি উভয়ের মাঝে কোষগত মিল না থাকত তবে পৃথিবীর মানুষ পানির মাছ ও স্থলের প্রাণীর গোশ্ত খেয়ে জীবন ধারণ করতে পারত না। সৃষ্টির কাঠামোগত ভিন্নতা সৃষ্টির জন্য স্রষ্টা মাঝে মাঝে সৃষ্টিতে নতুন নতুন ধারা প্রবর্তন করেছেন। এর ফলে নতুনের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে । নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণাও রয়েছে:

“আল্লাহ সৃষ্টিধারা প্রবর্তন করেন তারপর পুনরাবৃত্তি করেন।” (সূরা রূম আয়াত ২৭)

উপসংহারে বলা যায় জীব জগতের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে একটা সাংগঠনিক বিবর্তন বা উদ্দেশ্যমুখী বিবর্তন প্রচলিত ছিল। এ বিবর্তন ডারউইনের বিবর্তন নয়।

ডারউইনের বিবর্তন

ও স্রষ্টার উদ্দেশ্যমুখী বিবর্তনের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান। সৃষ্টিতে উদ্দেশ্যমুখী বিবর্তন চালু ছিল বলেই প্রতিটি জীবে মননবোধ কাজ করে। যখন নতুন প্রজাতির জীব সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তখনি স্রষ্টা পুরানো প্রজন্ম থেকে নতুনের উদ্ভব ঘটিয়েছেন। এভাবেই পানির জীব বিবর্তনের রশি বেয়ে বেয়ে স্থলে উঠেছে। তাই পানির জীবের জীবকোষের সাথে ডাঙ্গার জীবের জীবকোষের রয়েছে পুরোপুরি মিল।

সংগৃহীতঃ আদমের আদি উৎস
লেখকঃ আল মেহেদী

পোস্ট ট্যাগঃ

ডারউইন এর মতবাদ
চার্লস ডারউইন এর মতবাদ
ডারউইনের মতবাদ গুলি কি কি
ডারউইনের মতবাদ ভুল
ডারউইনের মতবাদ কী
ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ
ডারউইনের মতবাদ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url