খন্দকের যুদ্ধ কত সালে সংঘটিত হয়

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী, খন্দকের যুদ্ধ- Prophet Muhammad- Battle of trench

খন্দকের যুদ্ধ কত সালে সংঘটিত হয়

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জীবন ছিল খুবই ব্যস্ত জীবন। বিশেষ করে মদীনায় নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রে কদাচিত তাঁর এমন দিন কেটেছে যেদিন তাঁকে কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় নি। ছোটখাট সংঘর্ষ, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, চুক্তিলঙ্ঘন ইত্যাদি ছিল ব্যাপকাকার। 

তেমনি হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও মুসলমানদেরকে উত্যক্তকরণ ও বিদ্রুপ-কটাক্ষকরণ ছিল প্রতিদিনকার ব্যাপার। এসব কিছুই হচ্ছিল মদীনার ইয়াহুদী ও মক্কার কাফিরদের যোগসাজসে। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরস্পর হাত মিলিয়েছিল।

ইয়াহুদী গোত্র বনূ নাযীর চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কে হত্যার জন্যে ষড়যন্ত্র করে। এমতাবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়ে। তাদেরকে যুদ্ধ অথবা মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়া- এই দু'টি পন্থার যে কোন একটি বেছে নিতে বলা হয়। 

প্রথমে তারা স্বেচ্ছায় মদীনা ছেড়ে চলে যেতে অস্বীকার করে। কিন্তু পরে তাদেরকে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে বহিষ্কার করা হয়। তখন তারা মদীনা ছেড়ে খায়বারে চলে যায় এবং খায়বারকে মুসলমানদের শত্রুদের একটি ঘাঁটিতে পরিণত করে। তারা মক্কার কাফিরদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন করে হামলা চালাবার জন্যে উস্কানি দেয়। এভাবে তারা মুসলমানদেরকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালায়।

বদরের যুদ্ধে মক্কার কাফিররা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। উহুদের যুদ্ধেও তাদের স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়। তবে উহুদ যুদ্ধের ফলাফল তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন করে আক্রমণ চালাতে উৎসাহিত করে। কারণ বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সম্পর্কে তাদের মনে যে ধারণা গড়ে উঠেছিল, উহুদ যুদ্ধে তা বদলে যায়। আর বানূ নাযীরের উস্কানি তাদের অশুভ লক্ষ্য অর্জনে আরো বেশী আগ্রহী করে তোলে।

মক্কার কাফিরদের ও খায়বারের বানূ নাযীরের মধ্যে গোপনে দূত বিনিময় হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মদীনায় নতুন করে হামলা চালাবার ব্যাপারে দু'পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অতপর মক্কা, গাতাফান, তায়েফ, ফাযারা ও অন্যান্য শহর থেকে লোক যোগাড় করে এক বিরাট বাহিনী প্রস্তুত করা হয়। এভাবে বহু গোত্রের যোদ্ধাদের অংশগ্রহণের কারণে একে আহযাব (বহু দল)-এর যুদ্ধ বলা হয়।

সালমান ফারসি নামের অর্থ কি

হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এসব খবর এসে পৌঁছে। তিনি শত্রুদের এ সম্ভাব্য হামলা মোকাবিলার প্রস্তুতির জন্যে তাঁর ছাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন। আলোচনার ফলে মদীনায় থেকেই শত্রুদের মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সালমান ফারসি নামের অর্থ হচ্ছে নিরাপদ, 

তিনি ইরানী বংশোদ্ভূত সাহাবী হযরত সালমান আল্-ফারিসী (রাঃ) শত্রুবাহিনীকে মদীনার বাইরে থাকতে বাধ্য করার লক্ষ্যে শহরের চারদিকে খন্দক (পরিখা/খাল) খননের পরামর্শ দেন। তাঁর এ পরামর্শ সঠিক মনে হওয়ায় গ্রহণ ও কার্যকর করা হয়। একারণে এযুদ্ধকে খন্দকের যুদ্ধও (trench) বলা হয়

মদীনার চারদিকে প্রশস্ত ও গভীর পরিখা খনন করা হয়। এ কাজ শেষ করতে ২০ দিন লেগে যায়। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নিজেও পরিখা খননের কাজে অংশ নেন। পরিখা খনন শেষ হবার পর হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ভিতর থেকে শহরের প্রতিরক্ষার লক্ষ্যে মুসলমানদেরকে যথাযথ অবস্থান-সমূহে মোতায়েন করেন।

হিজরতের পঞ্চম বর্ষে অর্থাৎ ৬২৭ খৃস্টাব্দে বিভিন্ন অমুসলিম গোষ্ঠীর ১০ হাজার সৈন্যের এক সম্মিলিত বাহিনী মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হয়। তৎকালীন ছোট শহর মদীনা আক্রমণের জন্যে এটা ছিল একটা বিশাল বাহিনী। 

মনে হচ্ছিল তারা উত্তর, দক্ষিণ, উঁচু এলাকা ও নীচু এলাকা নির্বিশেষে সকল দিক থেকে মদীনার দিকে এগিয়ে আসছে। তারা রণঢাক বাজিয়ে ও রণসঙ্গীত গেয়ে মদীনার উপকণ্ঠে এসে থামে। কিন্তু নিজেদের ও মুসলমানদের মধ্যে প্রশস্ত ও গভীর পরিখা দেখে তারা বিস্মিত হয়।

ইসলামের দুশমনরা এ নতুন যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে কল্পনাও করে নি। তাই তারা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যায়। ফলে তাদের সামনে মদীনার বাইরে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন পথই রইল না। কিন্তু তারা কতদিন অপেক্ষা করতে পারবে?

প্রায় চার সপ্তাহ ধরে তারা অপেক্ষা করে। এ বিরক্তিকর প্রতীক্ষা তাদেরকে ক্লান্ত-শ্রান্ত ও অস্থির করে তোলে। এ দীর্ঘ অবরোধে কয়েকবার কিছু তীর বিনিময় ছাড়া আর কিছুই ঘটল না। ইসলামের দুশমনরা বেপরোয়াভাবে পরিখা পার হয়ে শহরে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু সদাসতর্ক বীর মুসলিম যোদ্ধারা তাদের সে চেষ্টা প্রতিহত করেন।

ইসলামের দুশমনদের খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ কমে যেতে থাকে। ফলে তারা খুবই উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা কি করবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না।

এমতাবস্থায় ইসলামের দুশমনরা একটা নতুন ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা করে। ইয়াহুদীদের অন্যতম গোত্র বানূ কুরাইযা তখনো মদীনায় বসবাস করছিল। শত্রুবাহিনীর নেতারা বানু কুরাইযার নেতাদের সাথে যোগসাজশ করে এবং তাদেরকে রাতের বেলা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আকস্মিক হামলা চালাবার জন্যে উৎসাহিত করে।

হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যথাসময়ে এ চক্রান্তের কথা জানতে পারেন এবং তা ব্যর্থ করে দেয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি মদীনার ইয়াহুদীদের নিকট একটি বাণী পাঠালেন। এতে তিনি শত্রুবাহিনী পরাজিত হলে তাদের এ বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি কি হবে তা ভেবে দেখতে বললেন।

খন্দকের যুদ্ধের ফলাফল

আহযাবের যুদ্ধ এর অপর নাম কি, অপর নাম হচ্ছে (খন্দক যুদ্ধ) শেষ হবার পর বনু কুরাইজা প্রায় তিন সপ্তাহ অবরোধ করে রাখা হয়। অতঃপর তারা বিচারের মাধ্যমে শাস্তি গ্রহণে রাযী হয়। তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের মিত্র বনূ আউসের নেতা হযরত সা'দ (রাঃ)-এর ওপর বিচারের ভার দেয়া হয়। 

তিনি ইয়াহূদীদের ধর্মীয় আইন অনুযায়ী বিচার করে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে বা কুরাইযার সকল প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ লোককে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করেন এবং এ রায়ের ভিত্তিতে তাদেরকে হত্যা করা হয়।

যা-ই হোক, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা'আলা সব সময় ও সর্বাবস্থায় সত্যপ্রেমিকদের সাথে থাকেন। সাফল্যের জন্যে তাঁর সাহায্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মদীনায় অবরুদ্ধ মুসলমানদের জন্যে এ সাহায্যের খুবই প্রয়োজন ছিল। আর শেষ পর্যন্ত সঠিক সময় তাঁরা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা'আলার সাহায্য লাভ করেন।

হঠাৎ করে আবহাওয়ায় পরিবর্তন ঘটে। প্রচণ্ড ঝড়, বৃষ্টি ও বজ্রপাত শুরু হয়ে যায়। ফলে ইসলামের দুশমনরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাদের ঘোড়া ও উটগুলো দিশাহারা হয়ে ছুটাছুটি করে, তাদের পায়ের নীচে পিষ্ট হয়ে বহু সৈন্য মারা যায়। 

ফলে ইসলামের দুশমনদের বিশাল বাহিনী তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। একবার চিন্তা করে দেখ এ দৃশ্যের কথা। আর চিন্তা করে দেখ আল্লাহ্ তা'আলা কেমন যথাসময়ে হস্তক্ষেপ করলেন। তিনি সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ। “তিনি যা চান তা-ই করে থাকেন।” (সূরাহ আল্ বুরুজ-১৬)

অবশেষে

এ পরিণতিতে ইসলামের দুশমনরা মারাত্মকভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মুসলমানরা খুবই নিশ্চিন্ততা বোধ করেন। দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ্ তা'আলা যথাসময়ে সাহায্য ও অনুগ্রহ করায় তাঁরা তাঁর নিকট আন্তরিকভাবে শুকরিয়া জানান।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url