হজ্জের নিয়ম কানুন

ইসলামের আলোকে হজ্জ করার নিয়ম- what is the hajj-Hajj 2023
ইসলামের আলোকে হজ্জ করার নিয়ম | what is the hajj-Hajj 2023

হজ্জের নিয়ম কানুন

হজ একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে ইচ্ছা করা বা সফর/ভ্রমণ করা। শরিয়তের পরিভাষায় হজ একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত জায়গায় ভিন্ন ধরনের কিছু কাজ সম্পাদন করাকে বুঝায়। 
হজ্বের সঠিক টাইম হলো শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ; বিশেষভাবে ৮ই জিলহজ্ব থেকে ১২ই জিলহজ্ব পর্যন্ত পাঁচ দিন। 
কাবা শরিফে তাওয়াফ ও বিভিন্ন জায়গায় হজের আনুষ্ঠানিকতা হয়ে থাকে। হজ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের ভ্রাতৃত্বের মহাসমাবেশ। হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে চতুর্থ এবং এটি অবশ্যই পালন করা উচিত। চাঁদ দেখার শর্ত সাপেক্ষে প্রতি বছর হিজরি মাসের ৯ই জিলহজ পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ততক্ষণ পর্যন্ত হাজীসহ প্রত্যেক মুসলমানের হজের গুরুত্ব ও ফজিলতজানা উচিত।

হজের ইতিহাস

হজ্ব ইসলামে নামাজ, রোজা এবং যাকাত এর মত একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ফরযে আইন ইবাদত হিসেবে বিবেচিত। এমন ব্যক্তির উপরই ফরয করেছেন এই পবিত্র হজ্ব যাকে মহান আল্লাহপাক নিসাব পরিমান সম্পদ 
অর্থাৎ সে জীবনে একবার তার দেশ থেকে মক্কায় মুকালামে ভ্রমণ করতে পারবে এবং হজ থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত তার পরিবারের প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে সক্ষম হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। হজ যে ফরজ তা কুরআন, হাদীস, ইজমা ও যুক্তি দ্বারা স্পষ্ট বলা আছে।

হজ্ব আল্লাহ তায়ালার একটি বিশেষ আদেশ। আর্থিক ও শারীরিক সক্ষমতাসম্পন্ন নারী-পুরুষের জন্য হজ একটি ফরজ ইবাদত। হজ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেন, হজ সেই লোকদের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ। যেসকল মানুষ এটা সম্পন্ন করার সামর্থ্য রাখে (সূরা আল ইমরান, ধারা ৯৭)। হাজার বছরের এই তীর্থযাত্রার প্রতিটি কর্মকাণ্ডে রয়েছে প্রাচীন মানব ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এটা মুসলমানদের ফরজ একটি ইবাদত। 
নবীজী সাঃ আল্লাহকে বিশ্বাস করতেন এবং ইসলাম পালন করতেন। নামাজের পর রোজা রাখা মুসলমানদের শরীরের ইবাদত। হজ হল বস্তুগত জিনিস ও অর্থের ইবাদত। তাই সবাইকে হজ করতে হবে না। হজ শুধুমাত্র প্রত্যেক সুস্থ ও সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য ফরজ। জীবিত বা মৃত যে কোনো ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ করা যায়। 
আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত বা অপরিচিত যেকেউ যে কারো হজ করতে পারেন বা বদলি হজ্ব করাতে পারেন। প্রতিস্থাপিত উপায়ে হজ করা শর্ত নয়, বরং হজের পরিবর্তে নতুন কোনো ব্যক্তিকে হজ করা হলে সে ব্যক্তির তাকওয়া, আন্তরিকতা, উৎসাহ ও অনুরাগ বেশি থাকতে হবে। 
তবে যারা হজ করতে সমর্থ তারা নিজেরা হজ আদায় না করে বদলী হজ্ব করাতে পারেন না। বদলী হজ আত্মীয় ও অনা-আত্মীয়, পুরুষ ও মহিলা দ্বারা করা যেতে পারে। তবে বদলী হজ্বের ক্ষেত্রে দ্বীনদারী লোককে দিয়ে করাতে পারলে ভালো হয়।

এ থেকে বোঝা যায় যে, হজ গ্রহণ করতে হলে তিনটি কাজ সঠিকভাবে করতে হবে:

  • ১. অভিপ্রায় বা ইচ্ছা সঠিক থাকতে হবে।
  • ৩. নির্ধারিত সময়ে হজ সম্পন্ন করতে হবে।
  • ৩. নির্দিষ্ট কার্যক্রমের মাধ্যমে হজ করা।

এই তিনটি কাজের যে কোনো একটি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে সম্পাদন না করলে হজের আমল অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

কুরআনের মাধ্যমে হজ যে ফরয তা নিচে দেওয়া হলোঃ হজ এমন কিছু ব্যক্তির উপর ফরয যার বর্ণনা আল কোরানের বিভিন্ন আয়াতে বিদ্যমান রয়েছে। যেমন:-

  • ১. আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য প্রদত্ত অধিকার আছে যে, যারা তাঁর গৃহে (বায়তুল্লাহ শরীফ) পৌঁছতে সক্ষম তারা যেন হজ সম্পন্ন করে। প্রকৃতপক্ষে, যারা এই আদেশ মানতে অস্বীকার করে (এবং তাদের এটি জানা উচিত), নিশ্চয় আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টির কারও প্রতি মুখপেক্ষী নন। আয়াত: ৯৭, কুরআন; আল ইমরান।
  • ২. আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ ও ওমরাহ সম্পূর্ণ করো যাদের উপর ফরয হয়েছে। আয়াত: ১৯৬, কুরআন বাকারা।
  • ৩. মানুষের প্রথম ঘর যেটি নির্মিত হয়েছেল সেটি মক্কায় কাবা ঘর; এটি বরকতময় এবং বিশ্বের কান্ডারী। এর অনেক সুস্পষ্ট লক্ষণ রয়েছে। ঠিক যেন মাকামে ইব্রাহিম। যে প্রবেশ করবে সেখানে সে নিরাপদ। আয়াত: ৯৬-৯৭; আল ইমরান।
  • ৪. মানুষের কাছে হজের ঘোষণা দিন এবং তারা আপনার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে, বিভিন্ন ছোট ছোট উটের পিঠে এবং তারা দীর্ঘ দূরত্ব ভ্রমণ করে। আয়াত: ২৭ সুরা হজ।

হাদীসের বাণী

১. হজরত আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের সামনে ভাষণ দিয়ে বললেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপরে হজ ফরজ করেছেন। তাই হজ্ব করতে হবে আবশ্যকীয়ভাবে। মুসলিম শরীফ

২. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যথা: (১) প্রমাণ করা যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, (২) সালাত কায়েম করা, (৩) যাকাত প্রদান (৪) বায়তুল্লাহ শরীফে গিয়ে হজ্ব করা এবং (৫) রমজানের সময় রোযা রাখা।

৩. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, একটি উমরা হজ্ব অপর উমরা হজ্ব পর্যন্ত মধ্যবর্তী সমুদয় গুনাহর জন্য কাফ্ফারা স্বরূপ। আর মাবরুর বা মাকবুল হজের সওয়াব বেহেশত ছাড়া আর কিছুই নয়। বুখারী ও মুসলিম শরীফ;

৪. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর প্রতি ঈমান আনা। নবীজী সাঃ কে আবার জিজ্ঞাসা করা হল: এর পরে কোন পদক্ষেপটি সর্বোত্তম? তিনি বলেন, জিহাদ করা মহান আল্লাহপাকের পথে। তাকে আবারো জিজ্ঞাসা করা হলো; এর পরে সর্বোত্তম পদক্ষেপ কী? জবাবে তিনি বলেন, হজ্জ মাবরুর’ অর্থ মকবুল হজ। বুখারী ও মুসলিম

৫. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:  যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করবে সে তার স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করবে না, বা ঔ বিষয়ে কথা বলবে না বা যৌনকর্মে লিপ্ত হবে না বা কোনো গোনাহের কাজে যুক্ত হবে না সে ব্যক্তি সদ্য ভুমিষ্ট শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে আসবে।বুখারী ও মুসলিম

৬. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ করতে চায় সে যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হজ করে। আবু দাউদ শরীফ হাদীস থেকে।

হজ কয় প্রকার ও কি কি

হজ তিন প্রকার। যেমন- তামাত্তু, ইফরাদ, কিরাণ। তন্মধ্যে সর্বোত্তম হজ্ব হচ্ছে কিরান, তারপর তামাত্তু, তারপর ইফরাদ। তবে ইবাদতের আরাম থেকে প্রথমে তামাত্তু, তারপর ইফরাদ, তারপর কিরাণ। 

তামাত্তু হজ করা সবচেয়ে সহজ, তাই বেশিরভাগ বাংলাদেশি তামাত্তু হজ করেন। আর যারা অন্যের পক্ষ থেকে হজে যান বা মিকাত হ্জ্ব করতে যান, তারা সাধারণত হজে ইফরাদ করেন। এর বাইরেও কিছু তীর্থযাত্রী রয়েছে যারা কিরাণ হজ্ব করে থাকেন যার সংখ্যা খুবই কম।

হজ্জ ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি?

শরিয়া আইনে কিছু শর্ত আরোপ করে যা কারো জন্য হজ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যারা নিম্নোক্ত শর্ত পূরণ করেন তারা যথাসময়ে হজ করতে বাধ্য থাকবে-

  • ১. মুসলিম হতে হবে
  • ২. স্বাধীন হতে হবে
  • ৩. পরিপক্ক বয়সী এবং জ্ঞানী হওয়া
  • ৪. সুস্থতা
  • ৫. চোখে ভালো দেখেন এমন ব্যক্তি
  • ৬. হজ্জের রাস্তা নিরাপদ করা
  • ৭. একজন মহিলার সাথে একজন স্বামী বা অন্য মাহরুম মুসলিম পুরুষ থাকবে।
  • ৮. পরিবারের খরচ ব্যতীত হজের যাবতীয় খরচ বহন করতে সক্ষম হতে হবে।

যদি কেউ হজ্জে অবহেলা করে এবং শর্ত থাকা সত্ত্বেও হজ না করেই মারা যায়, রাসূল (সাঃ) তাকে কঠোর শাস্তির কথা বলে দিয়ে বলেন: "যার আল্লাহর ঘর তথা মক্কায় যাতায়াতের সমর্থ থাকবে" কিন্তু তিনি হজ করেননি, তিনি একজন ইহুদি বা খ্রিস্টান হিসাবে মারা গেছেন তাতে কিছু যায় আসেনা। (তিরমিজিঃ ৮১২)

হজ্জের ফরজ ও ওয়াজিব কয়টি

হজ্জের ফরজ কাজ মোট তিনটি যথাঃ

  • ১. ইহরাম বাধতে হবে।
  • ২. আরাফাতের ময়দানে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করতে হবে।
  • ৩. কাবা শরীফ তাওয়াফ করতে হবে।

হজের ওয়াজিব কাজগুলো নিম্নরুপঃ

  • ১. মিকাত হতে ইহরাম বাধা
  • ২. সূর্য ডোবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আরাফায় থাকা
  • ৩. আরাফাতের মাঠে থাকতে হবে
  • ৪.  মিনাতে ১১, ১২, ও ১৩ই জিলহজের রাতে অবস্থান করা
  • ৫. জামারাই কঙ্কর নিক্ষেপ করা
  • ৬. মাথার চুল ছোট করা বা মুন্ডন করা
  • ৭. পশু কুরবানি করা
  • ৮. কাবা শরীফে শেষ বা বিদায়ী চক্কর দেওয়া

অবশেষেঃ

আল্লাহ আমাদের জীবনে একবার হলেও তার ঘর দেখার তৌফিক দান করুন। তিনি সবাইকে হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে অবগত করান এবং যথাসময়ে হজ করার তৌফিক দেন। আমীন!

অনলাইন থেকে সংগৃহীত

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url