হাশর কাকে বলে

হাশর কাকে বলে

হাশর কাকে বলে

আরবী শব্দ হাশরের অর্থ হলো এক হওয়া, জড়ো হওয়া বা একত্রিত হওয়া। একে আবার বিচারের দিন বা হিসাবের দিনও বলা হয়ে থাকে। নিচে আমরা জানবো হাশরের দিনের ভয়াবহতা বা পুলসিরাত ও মীযানের দিনে আমাদের কি হবে তা সংক্ষিপ্তভাবে কুরআন ও হাদীসের আলোকে তুলে ধরা হলো।

হাশরের ময়দানের ভয়াবহ অবস্থা

কুরআন ও বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে, হাশরের ময়দান হবে সমতল ভূমি। সেখানে কোন পাহাড় কোন উপশাখা কিংবা নদ-নদী থাকবে না। কোন নীচু ভূমি কিংবা টিলাও থাকবে না। আল্লাহ্ তা'আলা বলেন: “তারা তোমাকে পর্বত সমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে।

বল আমার প্রতিপালক তার সমুলে উৎপাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দিবেন। অতঃপর তিনি তাকে মসৃন সমতল ময়দানে পরিণত করবেন। যাতে তুমি বক্রতা ও উচ্চতা দেখতে পাবেনা। আল্লাহ্ তা'আলা আরও বলেন: “স্মরণ কর সেদিনের কথা যেদিন পর্বত মালাকে সঞ্চালিত করব। এবং তুমি পৃথিবীকে দেখবে উন্মুক্ত প্রান্তর, সেদিন তাদের সকলকে আমি সমবেত করব। এবং তাদের কাউকে অব্যাহতি দিবনা।”

হাদীস শরীফে আছে কিয়ামত দিবসে মানুষকে এক শুভ্র ঘাম পানিহীন পরিচ্ছন্ন সাদা ময়দার বুটির মত ভূমির উপর সমবেত করা হবে যেখানে কারো কোন চিহ্ন থাকবে না।'

হাউজে কাউসারে অবতরণ

‘হাউযে কাউছার' জান্নাতের একটি প্রস্রবন বা ঝর্ণাধারা। হাউযে কাউছারের অমীয় পানি উম্মতে মুহাম্মদীকে বিশেষ মর্যাদা স্বরূপ পান করানো হবে। আল্লাহ্ তা'আলা নবী (সা.)-কেএ নহর দান করে তার উম্মত ও তাঁকে মর্যাদা দান করেছিলেন। এই হাউজে কাউসার সম্পর্কে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, আমার হাওয দীর্ঘতায় ঈলা থেকে ইয়ামানে সানায়া পর্যন্ত হবে। আর তাতে পান পাত্র থাকবে আকাশের নক্ষত্রের সমপরিমাণ।”

আমাদের নবীর হাওয হবে সব চেয়ে বড়

আমরা এ হাওযের কথা বিশ্বাস করি কারণ তার সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসের সনদ মুতাওয়াতির পর্যায়ের। এবং তা প্রায় ত্রিশের অধিক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। অপর এক হাদীসে আছে, প্রত্যেক নবীর জন্য নির্দিষ্ট 'হাওয’ থাকবে। আমাদের নবীর হাওয হবে সব চেয়ে বড় সব চেয়ে উত্তম এবং তা থেকে পানকারীর সংখ্যা হবে সর্বাধিক।”

পানকারীর সংখ্যা সর্বাধিক হবে

অপর এক হাদীসে আছে, প্রত্যেক নবীর জন্য নির্ধারিত হাওয আছে। তারা অহংকার করতে থাকবে কোনটা পানকারীর সংখ্যা তা নিয়ে আর আমি আশা করি আমার হাওযে পানকারীর সংখ্যা সর্বাধিক হবে।"

আমলনামা ওযনের মীযান ও হাওযের মধ্যে কোনটার অবস্থান আগে সে ব্যপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে। কারো কারো মতে মীযান আগে। আবুল হাসান রহ. বলেন: সত্য কথা হল হাওযই আগে। আর কুরতুবী বলেন: যুক্তির দাবীও তাই।

পুলসিরাত পার হতে হবে

কারণ মানুষ কবর থেকে পিপাসার্থ অবস্থায় উঠে আসবে যেমনটি আমরা আগেই বলেছি। সুতরাং পিপাসার্থ মানুষের পিপাসা নিবারণের জন্য হাওযের অবস্থান আগে হবে মীযান ও পুলসিরাতের এটাই স্বাভাবিক। হাওয কাউছার হাশর ময়দানে সিরাতের আগে হওয়া যুক্তি সঙ্গত। কারণ কিছু মানুষকে হাওয কাউছারের পানি পান করতে দেয়া হবে না তারা পরে মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল বলে। এ সব লোকেরা তো পুলসিরাত পার হতে পারার কথা নয়।

হাওয কাউছার হাশর ময়দানে

এক হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেছেন, আমি তোমাদেরকে হাওয কাউছারে দ্রুত অতিক্রম করব। যে ব্যক্তি আমার পাশ দিয়ে যাবে সে তা থেকে পান করবে। আর যে পান করবে সে কখনও পিপাসিত হবে না। আমার কাছে কিছু মানুষ পান করবার জন্য আসবে।

আমি তাদেরকে তারাও আমাকে চিনবে। অতঃপর তাদের ও আমার মধ্যে পর্দা নেমে আসবে। তখন আমি বলব ওরা তো আমার উম্মত। তখন বলা হবে আপনি জানেন না তারা আপনার পর কি বিদআত সৃষ্টি করেছে। তখন আমি বলব দূরে সরিয়ে দাও দূরে সরিয়ে দাও ঐসব লোকদেরকে যারা আমার পর (দ্বীনে) বিকৃতি সাধন করেছে।”

সওয়াল-জওয়াব

আল্লাহ্ তা'আলার সামনে আনায়ন ও সাওয়াল-জওয়াব প্রাণি যগতকে সমবেত করার পর হিসেব-নিকাশের জন্য তাদেরকে আল্লাহ্ তা'আলার সামনে উপস্থিত করা হবে। তখন তারা দুনিয়ার জীবনে যা কিছু করেছে সে প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হবে।

প্রতিপালকের সামনে কাতারবদ্ধ ভাবে উপস্থিত

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা'আলা বলেন: “তাদেরকে তোমার প্রতিপালকের সামনে কাতারবদ্ধ ভাবে উপস্থিত করা হবে। তখন তোমরা আমার সামনে প্রথমবার তোমাদেরকে যে অবস্থায় সৃষ্টি করেছিলাম সে অবস্থায় উপস্থিত হবে। বরং তোমরা মনে করে আছ আমি তোমাদের জন্য আমার সামনে উপস্থিতির কোন সময় নির্ধারণ করিনি।

আল্লাহ্ তা'আলা আমল সম্বন্ধে গাওয়াল জবাব সম্পর্কে বলেন: “তোমার প্রতিপালকের শপথ, আমরা তাদের সকলকে প্রশ্ন করব, তারা দুনিয়ায় কি আমল করেছিল সে সম্পর্কে।”

মুয়ায ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেছেন হে মুয়ায লোকেরা কিয়ামত দিবসে সব তৎপরতা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হবে এমন কি চোখের সুরমা দেয়া প্রসঙ্গেও। এবং হাতের আঙ্গুল দ্বারা কাদা মাটি সরানো প্রসঙ্গেও। আমি যেন কিয়ামত দিবসে তোমাকে অন্য যে কারো চেয়ে আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন তার জন্য বেশী সৌভাগ্যবান পাই।

হিসাব-নিকাশ

অতঃপর বান্দার সব আমলের হিসাব-নিকাশ শুরু হবে। ছোট বড় কোন আমলই বাদ পড়বে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা'আলা বলেন: “তাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে, অতঃপর আমি অবশ্যই তাদের হিসেব নিব।

কাউকে সামান্যমত জুলুম করা হবে না

হিসাব-নিকাশ হবে প্রত্যেকে তার হাতে যে নিখুঁত আমলনামা দেয়া হবে পড়ার জন্য তার উপর ভিত্তি করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা'আলা বলেন: “যাদের ডান হাতে কিতাব বা আমলনামা দেয়া হবে তারা তাদের কিতাব পড়বে তাদেরকে সামান্যমত জুলুম করা হবে না।

আল্লাহ্ তা'আলা আরও বলেন: “তখন যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে সে বলবে লও তোমার আমলনামা, পড়ে দেখ। আমি জানতাম যে আমাকে আমার হিসেবের সম্মুখীন হতে হবে। সুতরাং সন্তোষজন জীবন লাভ করবে। সুমহান জান্নাতে। যার ফলগুলো অবনমিত থাকবে না গালের মধ্যে।

পানাহার কর তৃপ্তির সাথে

তাদেরকে বলা হবে পানাহার কর তৃপ্তির সাথে, তোমরা অতীত দিনে যা করেছিলে তার বিনিময়ে। আর যার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে সে বলবে হায়। আমাকে যদি আমার আমলনামা দেয়া না হত। এবং আমি যদি না জানতাম আমার হিসেব।”

আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে

আল্লাহ্ তা'আলা আরও বলেন: “যাকে আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে তাকে সহজ ভাবে হিসেব নেয়া হবে। এবং সে স্বপরিবারে আনন্দে ফিরে আসবে। আর যাকে তার আমলনামা পৃষ্ঠদেশ দিয়ে দেয়া হবে সে চিৎকার করতে থাকবে। এবং প্রজ্জ্বলিত আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। "

তারা যখন দুনিয়ায় কৃত তাদের আমলের হিসেব দিতে থাকবে তখন তাদের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবে যদি তারা কোন ব্যপারে মিথ্যা বলার চেষ্টা করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা'আলা বলেন:

তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ দিবে তার জিহ্বা, তাদের হাত, পা

“যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ দিবে তার জিহ্বা, তাদের হাত, পা, তারা দুনিয়ায় যা করেছে সে প্রসঙ্গে। আল্লাহ্ তা'আলা আরও বলেন: “আজকে তাদের মুখে তালা লাগিয়ে দিব, তাই তাদের হাতগুলো আমাদের সাথে কথা বলবে। আর তাদের পাগুলো সাক্ষ্য দিবে তারা কি করেছে সে বিষয়ে।”

মীযান বা দাঁড়িপাল্লা

যখন বান্দারা হিসেব দিতে থাকবে তাদের আমলের তখন তাদের আমলগুলো ওযন করার জন্য মীযান বা পাল্লা স্থাপন করা হবে। এ ভাবে তাদের আমলের ওযন করে তাদের মধ্যে ইনসাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা হবে।

আমি স্থাপন করব ন্যায় বিচারের মানদণ্ড

আল্লাহ্ তা'আলা বলেন: “এবং কিয়ামত দিবসে আমি স্থাপন করব ন্যায় বিচারের মানদণ্ড। সুতরাং কারো প্রতি কোন অবিচার করা হবে না। এবং কর্ম যদি তিল পরিমাণের ওযনেরও হয় তবুও তা আমি উপস্থিত করব। হিসেব গ্রহণকারীরূপে আমি যথেষ্ট।”

এ আয়াতের ৩৩; নং বাক্যে ‘মাওয়াযীন’ শব্দটি বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে। এ থেকে মনে হয় কিয়ামত দিবসে বান্দাদের আমলগুলো ওযন করার জন অনেকগুলো ন্যায় বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করা হবে। আবার বহুবচনের ব্যবহার বান্দাদের আমলের সংখ্যাধিক্যের কারণেও হতে পারে।

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আন্না মুহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ বাক্যটি ভারী হবে

সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় যে, মীযানের দুটি বাস্তব পাল্লা থাকবে, যা দেখা যাবে। আবু আব্দুর রহমান আল ইবিনী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-কে বলতে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেছেন, আল্লাহ্ তা'আলা অচীরেই আমার উম্মতের এক লোককে সৃষ্টির সামনে কিয়ামতের দিন নিয়ে আসবেন।

নিরানব্বইটি পাপের স্তুপ প্রকাশ করা হবে

তখন তার নিরানব্বইটি পাপের স্তুপ প্রকাশ করা হবে। প্রত্যেক স্তুপের ব্যপ্তি হবে চোখের দৃষ্টি যাওয়া পর্যন্ত। অতঃপর তাকে বলা হবে তুমি কি এসব পাপের মধ্যে কিছু অস্বীকার করতে চাও? আমার আমলনামা লেখকরা কি তোমার প্রতি জুলুম করেছে? সে বলবে, না হে আমার প্রতিপালক।

তখন আল্লাহ বলবেন তোমার কি কোন ওযর আপত্তি কিংবা সৎকর্ম আছে? তখন লোকটি হতবাক হয়ে যাবে। সে বলবে না হে আমার প্রভু। তখন আল্লাহ বলবেন হা আছে। তোমার একটা সৎকর্ম আমার কাছে গচ্ছিত আছে। আজকে তোমাকে জুলুম করা হবে না। তখন তার জন্য একটা কার্ড বের করে নিয়ে আসা হবে যাতে লিখা থাকবে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আন্না মুহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ'

তোমাকে কোন জুলুম করা হবে না

তখন সে বলবে হে আমার প্রতিপালক এ সব স্তুপের পাশে এই কার্ড দিয়ে কি হবে? তখন আল্লাহ বলবেন তোমাকে কোন জুলুম করা হবে না। মহানবী (সা.) বলেন: তখন পাপের স্তুপগুলো এক পাল্লায় আর কার্ডটি অপর পাল্লায় রাখা হবে। তখন স্তুপগুলো হালকা হয়ে যাবে আর কার্ডের পাল্লা ভারি হয়ে পড়বে।

আল্লাহর নামের তুলনায় অন্য কিছু ভারী হতে পারে না

আল্লাহর নামের তুলনায় অন্য কিছু ভারী হতে পারে না। অপর এক হাদীসে আছে, কিয়ামত দিবসে মানদণ্ড স্থাপন করা হবে, তখন লোকটিকে এনে এক পাল্লায় রাখা হবে।” এ বর্ণনা থেকে জানা গেল যে, আমলের সাথে মীযানের পাল্লায় আমলকারীকেও ওযন করা হবে।

পুলসিরাতের আগে এক অন্ধকারে থাকবে

বুখারী ইত্যাদির হাদীস থেকে এ ধরনের বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। ঘোর অন্ধকারের মুখোমুখি মানুষের হিসেব নিকাশের পর তারা পুলসিরাতের আগে একটা অন্ধকারের মুখোমুখী হবেন। আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ্ সা. কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল

যেদিন পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলী ধ্বংস হয়ে সব পরিবর্তন হয়ে যাবে সেদিন লোকেরা কোথায় থাকবে? মহানবী (সা.) উত্তরে বলেন তারা পুলসিরাতের আগে এক অন্ধকারে থাকবে।” এ স্থানে মুমিনরা মুনাফিকদের থেকে আলাদা হয়ে যাবেন, আর মুনফিকরা অন্ধকারে পড়ে থাকবে কিন্তু মুমিনরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।

মৃত্যুর পরে অনন্ত জীবন
মুহাম্মদ ইকবাল কীলানী

পোস্ট ট্যাগঃ

হাশর কাকে বলে
হাশর অর্থ কি
আল হাশর
হাশর বলতে কী বোঝায়
হাশর কী

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url