দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা

দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা

দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা
দ্বীনী জলসায় অংশ গ্রহণের ফজিলত

হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের একটি দলের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখেন তাঁরা একত্রে বসে আছে। তিনি তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা এখানে কেন বসে আছো?' তাঁরা জবাব দেন, 'আমরা এখানে বসে আল্লাহকে স্মরণ করছি এবং তাঁর শোকর আদায় করছি। কারণ তিনি আমাদেরকে ইসলামের রাস্তা দেখিয়েছেন এবং এভাবে আমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন।' নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'আল্লাহর কসম, তোমরা কি সত্যি এ কাজের জন্যে এখানে বসে আছো?' সবাই বললেন, 'হ্যাঁ, আল্লাহর কসম, আমরা এখানে বসে এই কাজই করছি।' হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে এ জন্যে কসম খাওয়াইনি যে, আমি তোমাদের মিথ্যাবাদী মনে করি। বরং জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এইমাত্র আমার কাছে এসে বললেন, 'আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের সভায় তোমাদের নিয়ে গর্ব করেন। (মুসলিম, তিরমিযী ও নাসাঈ)

  • ব্যাখ্যা: এই হাদীসে যিকরুল্লাহ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ হলো আল্লাহকে স্মরণ করা। এই শব্দ কোরআন ও হাদীসে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর দ্বারা যিকির ও দোয়া এবং অন্যান্য অজিফাও বোঝানো হয়েছে। আবার দ্বীন শেখা, শেখানো এবং দ্বীনী দাওয়াতের প্রসার প্রগতির চেষ্টা সাধনা ও সে সম্পর্কে সব কাজও যিকরুল্লাহর অন্তর্গত। এই হাদীসের যিকরুল্লাহর ব্যাখ্যা অন্যত্র এভাবে এসেছে, এরা সেখানে বসে আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দানের চর্চা করছেন। আমরা এই নবী আসার আগে আল্লাহর ইবাদতের সঠিক রাস্তা কি তা জানতাম না। তিনি আমাদের ওপর দয়া করে আমাদের মধ্য থেকে এক জনের মাধ্যমে আপন দ্বীন প্রেরণ করেছেন। তারপর আমাদের উপর তাঁর অতিরিক্ত অনুগ্রহ এই যে, তিনি আমাদেরকে ঈমান আনার তওফিক দান করেছেন। ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করার অর্থ হলো, আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের বলেন, ‘দেখো, আমার এই সব বান্দা আমাকে স্মরণ করছে, দ্বীনের কাজে রত আছে। এদের দেখো আর এদের দ্বীনী চিন্তা দেখো। এরা দুনিয়ার কারবার ও অন্যান্য কাজ বাদ দিয়ে এসব করছে।

দ্বীন শেখা এবং শেখানোর আগ্রহ থাকা জরুরী

হযরত বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “আমাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি নবীর জবান থেকে তাঁর কথা শুনতে পারতো না। কারণ আয় রোজগারের কাজে অনেককেই ব্যস্ত থাকতে হতো। অবশ্য যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনতেন তারা কখনো মিথ্যা কথা বলতেন না। ফলে যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সভায় উপস্থিত থেকে তাঁর কথা শুনতে পারতেন তারা সেই সভায় যারা উপস্থিত হতে পারেনি তাদেরকে নবীর বানী পৌঁছে দিতেন। (তাদের মধ্যে দ্বীন শেখার এবং দ্বীন শেখানোর আগ্রহ সমানভাবেই সক্রিয় ছিল)।

মিথ্যাবাদীর কথা বিশ্বাস করাও অন্যায়

হযরত কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এক হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাঁকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করে, 'আপনি কি এ হাদীস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে শুনেছেন?' তিনি বললেন, 'হ্যাঁ, অথবা বললেন, 'এমন এক ব্যক্তি আমাকে এ হাদীস বলেছেন যিনি মিথ্যা কথা বলেন না। আল্লাহর কসম, আমরা মিথ্যা কথা বলতাম না আর মিথ্যা কি তা আমরা জানতামও না।'

  • ব্যাখ্যা: মানুষ হাদীস বর্ণনায় কেমন সতর্কতা অবলম্বন করতো তা এ হাদীস দ্বারা পরিষ্কারভাবে জানা যায়। তারা কখনো মিথ্যা বর্ণনা দিতেন না এবং শ্রবণকারী পুরোপুরি অনুসন্ধান করে নিতেন হাদীসের সত্যাসত্য। এ হাদীস থেকে এ কথাও জানা গেল, যারা মিথ্যা বলে তাদের কথায় বিশ্বাস করা উচিত নয় এবং তাদের কথা সত্যি মনে করে অন্যের কাছে বলাও উচিত নয়।

দ্বীনী জ্ঞান অর্জনে মহিলাদের আগ্রহ

এক মহিলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে বলেন, “হে রাসূলুল্লাহ! আপনার সমস্ত শিক্ষা-দীক্ষা তো সব পুরুষরা শিখে নিচ্ছে! আমাদের জন্যও একটি দিন নির্দিষ্ট করে দিন, যে দিন আপনি আমাদেরকে আল্লাহর

হেদায়াত শিক্ষা দেবেন।' নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'অমুক দিন তোমরা সব একত্রিত হবে।' সুতরাং নির্দিষ্ট দিনে তারা একত্রিত হয় এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আল্লাহর হেদায়াত শিক্ষা দেন এবং সে সঙ্গে এ কথাও বললেন, 'যে মহিলার তিনটি ছেলে মারা যায় এবং সে সবর করে, তার সে মৃত ছেলে তাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর মাধ্যম হবে।' তখন এক মহিলা জিজ্ঞেস করেন, 'যদি কারো দুটো ছেলে মারা যায় তাহলে?' তিনি বললেন, 'দুটো ছেলের ব্যাপারেও একই কথা।” (বোখারী ও মুসলিম)

  • ব্যাখ্যাঃ এ হলো নবী করীম সা. এর সময়ের মহিলাদের নমুনা। তারা দ্বীন শেখার জন্য চিন্তা করতেন এবং চেষ্টা করতেন। এ জন্য তারা নিজেদের মধ্য থেকে এক মহিলাকে প্রতিনিধি হিসেবে রাসূলের কাছে পাঠান। কারণ তারা জানতেন, দ্বীন যেমন পুরুষের জন্য এসেছে তেমনি মেয়েদের জন্যেও এসেছে। পুরুষের নেকী ও দ্বীনদারী মহিলাকে বাঁচাতে পারবে না, প্রত্যেককে পৃথক পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। না পুরুষরা মহিলাদের ভার বহন করবে আর না মহিলারা পুরুষদের।

জবানের হেফাযত করা

হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মুক্ত গোলাম আসলাম বর্ণনা করেছেন, “একদিন হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু হযরত আবুবকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে উপস্থিত হন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পান, তিনি নিজের জিহ্বা হাত দিয়ে ধরে টানছেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, 'আপনি একি করছেন? আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন।' হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, 'এই জিভ আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।” (মেশকাত)

ব্যাখ্যা: জিহ্বা থেকে বহু অপরাধ সংঘটিত হয়। কখনো কারো গীবত হয়ে যায়, কখনো অশোভনীয় শব্দ বেরিয়ে যায়, কখনো মিথ্যা প্রকাশ হয়ে পড়ে। অর্থাৎ জিভ ভীষণ অসংযত প্রমাণিত হয়েছে। এই জিভের দ্বারা বহু ভুল ভ্রান্তি হয়ে থাকে বলে যাঁদের মধ্যে ঈমান আছে তারা এ জন্যে আফসোস করে থাকে। ঠিক এ রকম এক মনের অবস্থায় হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজের জিভকে শাস্তি দিচ্ছিলেন।

কর্মচারীদের তিরস্কার করার ব্যাপারে হুশিয়ারী

হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “একদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক সময় হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে উপস্থিত হন যখন তিনি নিজের চাকরদের তিরস্কার করছিলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, 'সিদ্দীক হয়ে তিরস্কার। কাবার প্রভুর কসম সিদ্দীক উপাধি প্রাপ্ত মুমিন তিরস্কার করবে এ রকম কখনোই হতে পারে না।

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এ কথা শুনে চাকরদের মুক্ত করে দেন, যাদের তিনি তিরস্কার করছিলেন। তারপর তিনি নবী করীম সা. এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, 'আমি তাওবা করছি, আমার দ্বারা এ রকম ভুল আর কখনো হবে না।” (মিশকাত)

সাহাবাগণ সালামের ব্যাপক প্রচলনের জন্য যা করতেন

হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “যখন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সফরে যেতাম তখন আমাদের মধ্যে কেউ কিছুক্ষণের জন্যে সরে গেলেও ফিরে এসে সালাম করতো। আমরা সকলেই এ রকম করতাম। দু'জন ব্যক্তির মধ্যে যদি এক গাছের আড়াল হয়ে যেতো এবং তারপর তারা মিলিত হতো তাহলে তারা সালাম বিনিময় করতো।” (তারগীব ও তারহীব)

ক্ষমা উপেক্ষার নীতি অবলম্বন করা

উয়ায়না ইবনে হিস্‌ আপন ভ্রাতুষ্পুত্র হুর ইবনে কায়েসের কাছে আতিথ্য গ্রহণ করেন। হুর ইবনে কায়েস সেই সব ব্যক্তিদের মধ্যে একজন, যারা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। কোরআনের আলেমগণ প্রাপ্তবয়স্ক হোক বা যুবক, হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গী ও পরামর্শদাতা ছিলেন। (হুর ইবনে কায়েস কোরআনের বিজ্ঞ আলেম ছিলেন এবং হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর পরামর্শদাতা ছিলেন)।

উয়ায়না আপন ভ্রাতুষ্পুত্রকে বললেন, ‘হে ভ্রাতুষ্পুত্র, তুমি তো আমীরুল মুমেনীন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সান্নিধ্য লাভ করেছো। তুমি তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দাও।' খলিফা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু উয়ায়নাকে তাঁর কাছে আসার অনুমতি দান করেন। উয়ায়না হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে উপস্থিত হয়ে কথোপকথনের সময় বললেন, 'হে ইবনে খাত্তাব; আল্লাহর কসম, আপনি আমাদেরকে বেশী ধন সম্পদ দান করেন না এবং আমাদের জন্যে ন্যায় বিচার করেন না।' এতে হযরত ওমর রাগান্বিত হন এবং উয়ায়নাকে শাস্তি দেবার মনস্থ করেন।

তখন হর ইবনে কায়েস বললেন, 'হে আমীরুল মুমেনীন! আল্লাহতায়ালা আপন নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,

'ক্ষমা ও উপেক্ষা করার নীতি অবলম্বন করো। নেকী ও ইহসানের হুকুম দাও এবং অজ্ঞানতা অবলম্বকারীর অজ্ঞানতাকে উপেক্ষা করো। (সুরাহ আরাফ আয়াত-১৯৯)

ইনি তো একজন জাহেল ও অজ্ঞ ব্যক্তি। সুতরাং এর ভুলকে ক্ষমা করে দিন।' এ কথা শুনে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সমস্ত ক্রোধ ঠান্ডা হয়ে যায়। তিনি এ আয়াত অনুযায়ী আমল করে তাকে ক্ষমা করে দেন। আর হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর কিতাবের কাছে দাঁড়িয়ে যাওয়ার ব্যক্তি ছিলেন।

পোস্ট ট্যাগঃ

দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা
দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা pdf
দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা বই নোট
দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা নোট
বই নোট দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url