কুরআন সংকলনের ইতিহাস

কুরআন সংকলনের ইতিহাস- History of Al Qur'an Compilation

কুরআন সংকলনের ইতিহাস
আল্লাহর কিতাবসমূহ

  • তাওরাত
  • যাবূর
  • ইনজিল
  • কুর'আন

আমরা জানতে পারলাম যে, মানুষ আল্লাহ্ তা'আলার বান্দাহ্ এবং পৃথিবীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি (খলীফা)। তবে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের জন্য আমাদের হেদায়াত বা পথনির্দেশের প্রয়োজন। 

যেহেতু আমাদের ভিতরে অনেক দুর্বলতা আছে এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত সেহেতু আমরা আমাদের নিজেদের জন্য পথনির্দেশ রচনা করতে অক্ষম। একমাত্র আল্লাহ্ই এসব দুর্বলতার উর্ধ্বে এবং একমাত্র তাঁরই ক্ষমতা রয়েছে সকল জায়গা ও সকল সময়ের মানুষের জন্যে উপযোগী হেদায়াত প্রদানের।

আমরা জানি যে, আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে হেদায়াত বিহীন অবস্থায় ফেলে রাখেননি এবং এ-ও জানি যে, আমাদের জীবনপথে চলার জন্যে সঠিক পথ দেখাতে তিনি তাঁর নবী-রাসূলগণকে (আঃ) পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি তাঁর নবী-রাসূলগণের (আঃ) মাধ্যমে হেদায়াত সম্বলিত কিতাব পাঠিয়েছেন।

আল্লাহ্ তা'আলার দয়া ও অনুগ্রহ সীমাহীন। আমাদের যা কিছু প্রয়োজন তার সব কিছুই তিনি আমাদেরকে দিয়েছেন। একটু চিন্তা করে দেখ, কেমন চমৎকারভাবে তিনি আমাদেরকে জন্ম থেকে শুরু করে যৌবনে উপনীত হওয়া পর্যন্ত পিতা-মাতার স্নেহ-মমতা ও আদর-যত্নের মধ্য দিয়ে বড় হওয়ার ব্যবস্থা করেছেন! 

আমরা যখন মায়ের পেটে থাকি তখন কে আমাদের জন্যে খাদ্যের ব্যবস্থা করেন? আমাদের জন্মের সাথে সাথে আমাদের পান করার জন্যে কে আমাদের মায়ের বুকে দুধের সঞ্চার করেন? নিঃসন্দেহে পরম দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ্ তা'আলাই এসবের ব্যবস্থা করেন।

কুরআন সংকলনের ইতিহাস

মানবজাতির প্রতি আল্লাহ্ তা'আলার সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ হচ্ছে আসমানী কিতাবসমূহের মাধ্যমে দেয়া হেদায়াত। বস্তুতঃ নির্ভুল, পরিপূর্ণ ও কল্যাণকর ‘ইলম বা জ্ঞান একমাত্র সর্বজ্ঞানী মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ্ তা'আলার নিকট থেকেই এসে থাকে। (আল-কুর'আন : সূরাহ আল-বাকারাহ্- ২ : ১৪৬ - ১৪৭)

একজন মুসলমান কুর'আন মজীদে উল্লিখিত সকল আসমানী কিতাবে ঈমান রাখে। এ কিতাবগুলো হচ্ছেঃ হযরত মূসা (আঃ)-এর ওপর নাযিলকৃত (অবতীর্ণ) তাওরাহ, হযরত দাউদ (আঃ)-এর ওপর নাযিলকৃত যাবূর, হযরত ‘ঈসা (আঃ)-এর ওপর নাযিলকৃত ইনজীল ও হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ওপর নাযিলকৃত কুর'আন। 

কুর'আন মজীদে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ওপর নাযিলকৃত পুস্তিকাসমূহের (ছুহুফে ইবরাহীম) কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

আসমানী কিতাব

আসমানী কিতাবসমূহের মধ্যে একমাত্র কুর'আন মজীদই অপরিবর্তিত রূপে সংরক্ষিত রয়েছে। মূল তওরাহ, যাবূর্ ও ইনজিল-এর এখন আর অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে এসব গ্রন্থের যে সংস্করণ পাওয়া যায় তা যেসব নবীর (আঃ) নামে প্রচলিত তাঁদের ইন্তেকালের 

বহুবছর পরে তাঁদের অনুসারীদের দ্বারা লিখিত। সংশ্লিষ্ট লেখকগণ আল্লাহ্ তা'আলার বাণীকে পরিবর্তন ও বিকৃত করেছেন। তাঁরা আল্লাহর কথাকে মানুষের কথার সাথে মিশ্রিত করেছেন।

‘পুরাতন নিয়ম' (ওল্ড টেস্টামেন্ট) ও 'নতুন নিয়ম' (নিউ টেস্টামেন্ট)-এর পুস্তকসমূহের সংকলন ‘বাইবেল' হচ্ছে প্রাপ্ত হিব্রু ও গ্রীক পাণ্ডলিপির ইংরেজী অনুবাদ। এতে যেসব সংযোজন ও পরিবর্তন করা হয়েছে যে কোন সচেতন ও সতর্ক পাঠক তা থেকে খুব সহজেই অন্ততঃ কতগুলো সংযোজন ও পরিবর্তন ধরতে পারবেন।

বর্তমানে প্রচলিত বাইবেলে প্রচুর ভুল চোখে পড়ে। এটি কোন আসমানী কিতাব নয়। এতে অসংখ্য বিভ্রান্তিকর ভ্রান্তধারণা ও নবীদের (আঃ) সম্পর্কে মিথ্যা বিবরণ রয়েছে। এসব নবী-রাসূলের (আঃ) মাধ্যমে আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে পাঠানো বাণী তাঁদের অনুসারীদের অবহেলা বা নির্বুদ্ধিতার কারণে হয় হারিয়ে গেছে, নয়ত বিকৃত হয়েছে। 

অন্যদিকে কুর'আন মজীদে মানবজাতির জন্যে আল্লাহ্ তা'আলার দেয়া হেদায়াত মূল রূপে ও মূল ভাষায় অপরিবর্তিত ও অবিকৃত রয়েছে। অতীতের নবী-রাসূলগণের (আঃ) ওপর নাযিলকৃত আল্লাহ্ তা'আলার যেসব বাণী তাঁদের অনুসারীরা হারিয়ে ফেলেছিল কুর'আন মজীদ তা সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পুনরায় পেশ করেছে। কুর'আন মজীদের বাণী সকল কালের ও সকল পরিবেশের জন্য প্রযোজ্য।

আল কুরআন (al quran)

কুর'আন মজীদ এক অতুলনীয় কিতাব। এ কিতাবটি আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে সকল মানুষের জন্যে হেদায়াত হিসেবে নাযিল করা হয়েছে। কুর'আন মজীদ মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এটি ইসলামী আইন-কানুন বিধি-বিধানের প্রধান উৎস। কুর'আন মজীদের প্রতিটি শব্দই আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে।

কোরআন কোথায় নাজিল হয়েছিল

কুর'আন মজীদ মানবজাতির নিকট আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে পাঠানো সর্বশেষ আসমানী কিতাব (ঐশী গ্রন্থ)। ৬১০ খৃস্টাব্দে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন হিরা গুহায় আল্লাহ্ তা'আলার ধ্যানে মগ্ন ছিলেন তখন তাঁর ওপরে ওহী (খোদায়ী প্রত্যাদেশ) আকারে কুর'আন নাযিল শুরু হয়। 

আমরা ইতিমধ্যেই যেমন উল্লেখ করেছি, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পূর্বেকার বিভিন্ন নবী-রাসূলের (আঃ) ওপর যেসব আসমানী কিতাব নাযিল করা হয় সেগুলো মূল রূপে মওজুদ নেই। কেবল কুর'আন মজীদই অপরিবর্তিত রয়েছে। 

তাই এ বিশ্ব ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্যে কুর'আন (al quran) মজীদই একমাত্র হেদায়াতের কিতাব। এ কারণে কুর'আন মজীদ আসল রূপে সংরক্ষিত রাখা এবং মানুষের দ্বারা বিকৃত হওয়া থেকে যে মুক্ত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা, এ কিতাব চিরস্থায়ী হেদায়াতের কিতাব।

লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করার দৃষ্টিতে বিশ্বের অন্য কোন গ্রন্থকেই কুর'আন মজীদের সাথে তুলনা করা চলে না। আল্লাহ্ তা'আলার এ কিতাবের একটি বিস্ময়কর দিক এই যে, এটি পুরোপুরি অপরিবর্তিত রয়েছে। এমন কি বিগত চৌদ্দশ' বছরে এর একটি বিন্দুও পরিবর্তিত হয় নি। 

এর কারণ স্বয়ং আল্লাহ্ তা'আলা কুর'আন মজীদের হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন। আল্লাহ্ তা'আলা কুর'আন মজীদে এরশাদ করেন:

إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ ذَ

“নিঃসন্দেহে আমরা এ যিকর (কুর'আন) নাযিল করেছি এবং আমরাই এর হেফাযতকারী।” (সূরাহ আল্-হিজ্র্-১৫: ৯)

এ আয়াত থেকে জানা যাচ্ছে যে, আল্লাহ্ তা'আলাই কুর'আন নাযিল করেছেন এবং তিনিই এর হেফাযত করবেন। আর বাস্তবেও তা-ই দেখা যাচ্ছে; তিনি এ কিতাবকে যে কোন ধরনের পরিবর্তন থেকে রক্ষা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও- চিরদিন একে রক্ষা করবেন।

কুরআনের সূরা সমূহ

কুর'আন মজীদের সূরাহসমূহ (surahs of the quran) এমনই অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে, মহান স্রষ্টা ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই তা রচনা করা সম্ভব নয়। আল্লাহ্ তা'আলা সমগ্র মানব ও জিন জাতিদ্বয়কে সম্মিলিতভাবে কুর'আনের সমতুল্য একটি গ্রন্থ রচনার চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন এবং সেই সাথে জানিয়ে দিয়েছেন যে, 

তারা কখনোই তা করতে পারবে না। (আল্-কুর'আন : সূরাহ আল্-বাকারাহ্ - ২ : ২৩) এ চ্যালেঞ্জ কেউ গ্রহণ করতে পারে নি এবং ভবিষ্যতেও কেউ গ্রহণ করতে পারবে না।

কুর'আন মজীদ নাযিল হওয়ার সাথে সাথেই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে লিপিবদ্ধ করা হয়। কুর'আন মজীদ আজও অপরিবর্তিত ও অবিকৃতভাবে এর আসলরূপে বিদ্যমান রয়েছে। সামান্যতম পরিবর্তন ছাড়াই এ কিতাবটি শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে আছে- এ অর্থে এটি একটি জীবন্ত অলৌকিক জিনিস Miracle বা মু'জিযাহ্।

এর প্রতিটি শব্দ প্রতিটি বর্ণ ও ধ্বনি- হাজার হাজার মুসলমানের অন্তরে সংরক্ষিত রয়েছে যাঁরা এ কিতাবটি মুখস্ত (হেফ্জ) করে রেখেছেন ও রাখছেন এবং প্রতিদিন তেলাওয়াত (পাঠ) করছেন। এতে এর মূল অংশে (Text) কোনরূপ পার্থক্য দেখা যায় না। তোমরা নিজেরাও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের কুর'আন তেলাওয়াত শুনে তুলনা করে এ বিষয়ে পরখ করে দেখতে পার।

বাংলা আল কুরআনঃ (bengali al quran)

অন্যান্য আসমানী কিতাব যে সব ভাষায় নাযিল হয়েছিল তার বিপরীতে আরবী ভাষা-কুর'আনের ভাষা-এখনো একটি জীবন্ত, গতিশীল ও সমৃদ্ধ ভাষা। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে আরবী ভাষা (bengali al quran) ব্যবহার করে। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, এমন কি আজকের পৃথিবীতেও কুর'আনের বাস্তবায়ন এবং এ কিতাব থেকে সার্বজনীন কল্যাণ হাসিল করা সম্ভব।

কুর'আন মজীদের মাধ্যমে আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তা'আলা আমাদের সাথে কথা বলেন। এ থেকে সমগ্র সৃষ্টিলোকের ওপর তাঁর সার্বভৌমত্বের এবং তিনি যে সর্বজ্ঞানী ও সব কিছু দেখতে পান তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলে। কুর'আন মজীদের বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষ ও তার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।

মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের সকল দিকই কুরআনের আওতাভুক্ত। মানুষের কর্মতৎপরতার প্রতিটি ক্ষেত্র সম্বন্ধেই এতে নীতিমালা, শিক্ষা ও হেদায়াত রয়েছে। কুর'আনের মূল বক্তব্য প্রধানতঃ তাওহীদ, রিসালাহ্ ও আখিরাহ্ এই তিনটি মৌলিক ধারণা সম্পর্কে ।

তাওহীদ

কুর'আনের মূল মর্ম হচ্ছে তাওহীদ। আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো সকল নবী-রাসূলই (আঃ) মানুষকে তাওহীদের দিকে আহ্বান করেছেন। আল্লাহ্ তা'আলার প্রকৃত অনুগত বান্দাদেরকে যে জান্নাত দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে কুর'আন মজীদ তার এক প্রাণবন্ত বর্ণনা দিয়েছে। 

তেমনি পাপাচারীদেরকে যে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে কুর'আন মজীদে তারও জ্বলন্ত ও ভয়াবহ বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

কুর'আন মজীদ তার হেদায়াত ও শিক্ষা অনুসরণের জন্য মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বস্তুতঃ কুর'আন মজীদের শিক্ষা অনুসরণের মধ্যেই মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের সাফল্য নির্ভর করে। 

আমরা যদি কুর'আনের অনুসরণ না করি তো আল্লাহ্ তা'আলার বান্দাহ্ ও প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। কুর'আন আমাদেরকে আমাদের সমাজে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা এবং যাবতীয় নিষিদ্ধ ও পাপাচারকে উৎখাত করার আহ্বান জানায় ৷

কুর'আন মজীদের চমৎকার প্রকাশভঙ্গি এর পাঠক-পাঠিকাদের ওপর দারুণ প্রভাব বিস্তার করে। যারা কুর'আন মজীদে ঈমান রাখে ও এর শিক্ষা অনুযায়ী আমল করে কুর'আন তাদের জীবনধারাকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে দেয়। 

এমন কি কুর'আন তেলাওয়াতকারী (পাঠকারী) ব্যক্তি যদি এর অর্থ পুরোপুরি বুঝতে না-ও পারে তথাপি আল কুর'আন (al quran) তেলাওয়াত তেলাওয়াতকারীর অন্তরে এক অনাবিল প্রশান্তি সৃষ্টি করে। এর অবিশ্বাস্য প্রভাব মানুষের বর্ণনাশক্তির উর্ধে। কুর'আন তেলাওয়াতের প্রভাব সঠিকভাবে অনুধাবন একমাত্র বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই সম্ভব।

কুরআনের নাযিল সংগ্রহ সংকলন
কুরআনের লেখক কে

কুর'আন মজীদ জিবরাঈল (আঃ) ফেরেশতার মাধ্যমে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ওপর নাযিল হয়। কুর'আন এক সঙ্গে নাযিল হওয়া কোন কিতাব নয়। কুর'আনের আয়াতসমূহ পর্যায়ক্রমে ও প্রয়োজন অনুসারে নাযিল হয় এবং 

দীর্ঘ তেইশ বছরে কুর'আন নাযিল সমাপ্ত হয়। আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে জিবরাঈল (আঃ) ফেরেশতার মাধ্যমে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট কুর'আন মজীদের যে কোন আয়াত বা সূরাহ নাযিল হওয়ার সাথে সাথে তার প্রতিটি শব্দ লিখে রাখা হয়।

আল কুরআন কোথায় সংরক্ষিত

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর যুগের মুসলমানদের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন সময়ে কুর'আনের আয়াত ও সূরাহসমূহ নাযিল করা হয়। কোন্ সূরাহর পর কোন্ সূরাহ এবং কোন্ আয়াতের পর কোন্ আয়াত বসবে জিবরাঈল (আঃ) ফেরেশতা অত্যন্ত সাবধানতার সাথে তা হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে শিক্ষা দেন। 

কুর'আনের আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার সময়ের ভিত্তিতে সাজানো হয়নি বা বিষয়বস্তুর ভিত্তিতেও সাজানো হয়নি। বরং স্বয়ং আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও নির্দেশ অনুযায়ী এর আয়াত ও সূরাহগুলোকে সাজানো হয়। বস্তুতঃ এ-ও কুর'আন মজীদের আরেকটি আকর্ষণীয় অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য। হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর বেশ কয়েকজন সচিব ছিলেন। 

কোন সাহাবীকে কুরআন একত্রিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল?

তাঁদের মধ্যে হযরত যায়েদ্ বিন্ সাবিত্ (রাঃ) অন্যতম। তিনি কুর'আনের আয়াত লিখে রাখার কাজ করতেন। হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যেভাবে বলতেন যায়েদ্ বিন্ সাবিত্ (রাঃ) ঠিক সেভাবে কুর'আনের আয়াতসমূহ লিখে রাখতেন। লেখা শেষ হলে তিনি তা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে পড়ে শোনাতেন।

কোরআন সংরক্ষণের ইতিহাস
আল কুরআন ৩০ পারা

কুর'আন মজীদে ১১৪টি সূরাহ রয়েছে। কুর'আন মজীদের ভূমিকাস্বরূপ বা উদ্বোধনী হিসেবে একটি ছোট সূরাহকে স্থান দেয়া হয়েছে। এর নাম সূরাহ আল্‌-ফাতিহা। এরপরেই স্থান দেয়া হয়েছে কুর'আন মজীদের সবচেয়ে দীর্ঘ সূরাহকে; এর নাম সূরাহ আল্-বাকারাহ্ (মানে গাভী)। 

এতে ২৮৬টি আয়াত রয়েছে। এরপর একেরপর এক অপেক্ষাকৃত ছোট সূরাহগুলোকে স্থান দেয়া হয়েছে। কুর'আন মজীদের সব চেয়ে ছোট সূরাহর নাম ‘সূরাহ আল্-কাউছার ’(এর মানে আধিক্য বা প্রাচুর্য)। এ সূরাহ-টিতে মাত্র তিনটি আয়াত রয়েছে।

কুর'আন মজীদে সর্বমোট ৬ হাজার ২৩৬টি আয়াত রয়েছে। হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) মক্কায় বসবাসকালে যেসব সূরাহ নাযিল হয় সেগুলোকে মাক্কী (Makkan) সূরাহ এবং তিনি হিজরত করে মদীনায় চলে আসার পর নাযিল হওয়া সূরাহগুলোকে মাদানী (Madinan) সূরাহ বলা হয়।

এছাড়া তেলাওয়াতের সুবিধার জন্য কুর'আন মজীদকে মোটামুটি সমান তিরিশ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এর প্রতিটি ভাগকে ‘পারা' বলা হয়।

হাফেজ অর্থ কি

প্রথম যুগের মুসলমানদের অনেকেই কুর'আনের আয়াত বা সূরাহ নাযিল হলে সাথে সাথেই মুখস্ত করে নিতেন। কুর'আন মুখস্তকারীকে ‘হাফিয’ বলা হয়। রাসূল (সাঃ) এর সময়কার কয়েকজন বিখ্যাত হাফিযের নামঃ

হযরত মু'আয বিন জাবাল্,

হযরত ‘উবাদাহ্ বিন্ আস্-সামিত্,

হযরত আবুদারদা',

হযরত আবু আইয়ুব আল-আনছারী

ও হযরত উবাই বিন কা'ব, (রাদিয়াল্লাহু 'আনহুম্)।

৬৩২ খৃস্টাব্দে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর (ওফাত) ইনতেকালের কিছুদিন পরেই হযরত ‘উমার (রাঃ) খলীফাহ্ হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে কুর'আন মজীদকে একটি কিতাব আকারে সংকলন করার প্রস্তাব দেন। 

ঐ সময় পর্যন্ত কুর'আন বিভিন্ন ভাগে আলাদা আলাদা লেখা ছিল। হযরত আবু বকর (রাঃ) এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং কুর'আনকে একখণ্ডে সংকলন করার জন্য হযরত যায়েদ্ বিন্ সাবিত্ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কুর'আন মজীদ সংকলনের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। কুর'আন মজীদ হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সময়ে যেভাবে লেখা হয়েছিল ঠিক সেরূপ নিখুঁতভাবে লেখা হয়। 

লেখার পর তা সতর্কভাবে পরীক্ষা ও পুনঃপরীক্ষা করে একটি কিতাবাকারে সংকলিত করা হয়। ইসলামের ইতিহাসের দ্বিতীয় খলীফাহ্ হযরত উমার (রাঃ)-র খিলাফার সময় কুর'আন মজীদের এ কপিটি হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর অন্যতম বিধবা স্ত্রী হযরত হাফসাহ (রাঃ)-র নিকট রাখা হয়।

পরবর্তীকালে মুসলিম অধ্যুষিত সকল এলাকায় কুর'আন শিক্ষা দেয়ার জন্য দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (মাদরাসাহ্) গড়ে ওঠে। হযরত ‘উমার (রাঃ)-র সময় বিখ্যাত হাফিজদের অন্যতম হযরত আবুদ্দারদা (রাঃ) দামেশকে এ ধরনের একটি মাদরাসাহ্ পরিচালনা করতেন৷ এর ছাত্রসংখ্যা ছিল এক হাজার ছয়শত

কোরআন শরীফ

ইসলামী হুকুমাতের সম্প্রসারণের ফলে বিভিন্ন এলাকার লোকেরা স্থানীয় উচ্চারণ ও সুরে কুর'আন তেলাওয়াত করতে শুরু করে। এর ফলে মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ভুল বুঝাবুঝির আশঙ্কা করে তৃতীয় খলীফাহ্ হযরত উসমান (রাঃ) কুরাইশদের উচ্চারণে কুর'আন মজীদের একটি আদর্শ কপি তৈরীর নির্দেশ দেন। 

কারণ, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কুরাইশ্ গোত্রেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হযরত যায়েদ্ বিন্ সাবিত্‌, হযরত আবদুল্লাহ্ বিন্ আয্-যুবায়র, হযরত সা'ঈদ্ বিন্ আল্-আস্ ও হযরত আবদুর রহমান বিন্ আল্-হারিস্ (রাঃ) কে হযরত হাফসাহ্ (রাঃ)-র নিকট সংরক্ষিত কপি থেকে একটি আদর্শ কপি করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এ কপি তৈরী হলে সকলকে এ থেকে পুনঃ কপি করার বা নিজ নিজ কপি এর সাথে মিলিয়ে নিয়ে সংশোধন করার নির্দেশ দেয়া হয়।

হযরত ‘উসমান (রাঃ)-র এ দূরদর্শী পদক্ষেপের ফলে কোরআন শরীফের অভিন্ন তেলাওয়াত সম্ভবপর হয়। খলীফাহ্ হযরত উসমান (রাঃ)-র সময়কার কুর'আন মজীদের দু'টি মূল কপি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এর মধ্যে একটি কপি তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের তোপ্‌কাপী যাদুঘরে ও অপর কপিটি উযবেকিস্তানের তাশখন্দ শহরে রয়েছে। 

পাকিস্তানের করাচী নগরীর দ্য ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে তাশখন্দের কপিটির একটি ফটোকপি আছে ৷ ৬১০ খৃস্টাব্দে মক্কাহ শরীফের জাবালুন্ নূর (নূর পাহাড়)-এর হিরা' গুহায় হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট কুর'আন নাযিল শুরু হয়। সর্বপ্রথম যে আয়াতগুলো নাযিল হয় তা হচ্ছেঃ

সূরা আলাক

ইকরা' বিছমি রাব্বিকাল্লাযী খালাক্ব, খালাকাল ইন্‌সানা মিন ‘আলাক্ব ইকরা' ওয়া রাব্বুকাল্ আক্রাম্,

আল্‌লাযী ‘আল্লামা বিল্‌কালাম, ‘আল্লামাল ইনসানা মা লাম্‌ ইয়া'লাম’ আল কুরআন থেকে সহিহ শুদ্ধ করে দেখে নিবেন।

কোরআন সর্বপ্রথম কিসের কথা বলেছে?

পড় কথাটি সর্বপ্রথম বলা হয়েছে আল কুরআনে।

পড় তোমার রবের (প্রভুর) নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘পরস্পর জড়িত বস্তু' (প্রাথমিক ভ্রূণ) থেকে সৃষ্টি করেছেন, পড়, আর তোমার রব বড়ই মহানুভব, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।

(সূরা আল্-‘আলাক (surah alak) ১-৬)

জাবালুন নূরের হিরা' গুহায় নাযিল শুরু হবার পর দীর্ঘ ২২ বছর মাস ১৪ দিনে পুরো কুর'আন মজীদ নাযিল সমাপ্ত হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url