আযানের ইতিহাস

আজানের ইতিহাস-History of Azan

আযানের ইতিহাস

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মদীনায় আগমন ছিল সেখানকার জনগণের জন্যে সবচেয়ে বড় স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। 

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাদের মধ্যে আসায় ও অবস্থান করায় তাদের মধ্যে আনন্দ-উল্লাসের ঢেউ বয়ে যায়।

আল- নববী মসজিদঃ
Al-Nabawi Mosque

মদীনার অবস্থান মক্কা থেকে উত্তর দিকে। সড়কপথে দুই শহরের মধ্যে দুরত্ব ৪৪৭ কিলোমিটার আর বিমানযোগে ৩০০ কিলোমিটার। সে যুগে শহরটির নাম ছিল ইয়াছরিব। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমন ও অবস্থানের কারণে ধীরে ধীরে শহরটি 'মাদীনাতুন্নাবী' বা 

‘নবীর শহর' হিসেবে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে সংক্ষেপে শুধু ‘মাদীনাহ্' বলতেই ‘মাদীনাতুন্নাবী’ বুঝায় এবং শেষ পর্যন্ত সারা দুনিয়ায় ‘মদীনা' (মাদীনা) হিসেবে বিখ্যাত হয়।

মক্কার মুহাজিরদের আগমনের ফলে মদীনার জনজীবনের চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। এখন সেখানে তিনটি জনগোষ্ঠী হল- দু'টি মুসলিম জনগোষ্ঠী ও একটি অমুসলিম জনগোষ্ঠী। একটি ছিল মক্কা থেকে আগত মুহাজিরীন (মুহাজির জনগোষ্ঠী), একটি ছিল আউস ও খাযরাজ গোত্রভুক্ত আনছার জনগোষ্ঠী, আরেকটি ছিল কাইনুকা, নাযির ও কুরাইযাহ্ গোত্রভুক্ত ইয়াহুদী জনগোষ্ঠী। 

স্থানীয় আনছাররাই মুহাজিরদের আশ্রয় দেন। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মদীনায় এসে পৌঁছার পূর্বেই তাঁর কতক সাহাবী সেখানে এসে পৌঁছেছিলেন। তাঁরা আনছারদের সাথে তাঁদের মেহমান হিসেবে বসবাস করছিলেন হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমনের ফলে পরিস্থিতি অধিকতর নিশ্চিতরূপ ধারণ করে। ইতিমধ্যে মক্কা থেকে অন্যান্য মুসলমানরাও চলে আসতে থাকেন।

মুহাজিরগণ প্রায় খালি হাতে মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে আসেন। তাঁদের সাথে কোন ধনসম্পদ ছিল না। এমতাবস্থায় হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) সর্বপ্রথম যে কাজটি করা প্রয়োজন মনে করলেন তা হচ্ছে আনছার ও মুহাজিরীনদের মধ্যে ঈমান ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলা। 

এ উদ্দেশ্যে তিনি আনছার ও মুহাজিরীনদের একটি সভা ডাকলেন। এ সভায় তিনি আনছারদের প্রত্যেককে একজন করে মুহাজিরকে ঈমানী ভাই হিসেবে গ্রহণ করতে বললেন। তিনি তাঁদেরকে তাঁদের ধনসম্পদ ও বাড়ীঘর মুহাজিরদের সাথে ভাগ করে নেয়ার জন্যে উপদেশ দিলেন। আনছাররা হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর আহ্বানে পুরোপুরি সাড়া দিলেন।

বস্তুতঃ এটা ছিল মানবজাতির ইতহিাসের এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। ইসলাম যে আনছারদের চিন্তাচেতনাকে কতখানি প্রভাবিত করেছিল এ ঘটনা থেকে তা বুঝা যেতে পারে। তাঁদের নিকট পরকালীন পুরস্কারের মোকাবিলায় দুনিয়ার ধনসম্পদ খুবই গুরুত্বহীন বলে মনে হয়েছিল। 

তাই আনছাররা তাঁদের সকল ধনসম্পদ তাঁদের ঈমানী ভাই মুহাজিরদের সাথে প্রায় সমানভাবে ভাগ করে নেন। এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এটা ইসলামের ইতিহাসের এক সর্বজনস্বীকৃত ঘটনা।

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মদীনার নেতায় পরিণত হলেন। তিনি আনছার ও মুহাজিরীনদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরীর মাধ্যমে কার্যতঃ ইসলামী সমাজের উদ্বোধন করেন। এভাবে মদীনা ইসলামী সমাজ ও প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানীতে পরিণত হল।

মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে শাসক ও শাসিতের মধ্যে কোন বৈষম্য ছিল না। প্রত্যেক নাগরিকই সকল অধিকার ভোগ করত। কারণ ইসলাম তাকওয়া (আল্লাহকে ভয় করে চলা) ছাড়া অন্য কিছুর ভিত্তিতে কারো ওপরে কারো মর্যাদা স্বীকার করে না। আল্লাহ্ তা'আলা কুর'আন মজীদে এরশাদ করেন:

“নিঃসন্দেহে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে-ই সর্বাধিক সম্মানের অধিকারী যে সবচেয়ে বেশী তাওয়ার অধিকারী।” (সূরাহ্ আল্-হুজুরাত্-১৩)

তাই মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে বর্ণ, গোত্র বা শ্রেণীর ভিত্তিতে কোনরূপ বৈষম্য ছিল না। হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করার পর সেখানে আভ্যন্তরীন শান্তি নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেন। তিনি ইয়াহুদী ও অন্যান্য গোত্রের লোকদের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। 

এ থেকে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর দূরদর্শিতারই পরিচয় পাওয়া যায়। মদীনার সকল অধিবাসী যাতে শান্তিতে ও নিরাপদে বসবাস করতে পারে সে লক্ষ্যে তিনি সেখানে বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু ইয়াহুদীরা তাদের অঙ্গীকার রক্ষা করেনি; পরবর্তীকালে তারা চুক্তির শর্তবালী ভঙ্গ করে তার বিপরীত কাজ করে।

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মদীনায় একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মদীনায় এসে পৌঁছার পর তাঁর উট প্রথমে দু'জন ইয়াতীমের জায়গায় বসেছিল এবং তার পর পরই উঠে গিয়ে হযরত আবু আইয়ূব আনছারী (রাঃ)-এর বাড়ীতে বসে। 

তিনি উক্ত সাহাবীর বাড়ীতে বাস করতে থাকেন। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) উক্ত দুই ইয়াতীমের জায়গাকেই মসজিদ তৈরীর জন্য বেছে নেন। এই দুই ইয়াতীমের নাম ছিল সুহাইল ও সাহল। তিনি তাদের কাছ থেকে জায়গাটি কিনে নেন। সেখানে মসজিদ তৈরী করা হয় এবং তার পাশেই তাঁর বসবাসের জন্য ঘর তৈরী করা হয়।

মসজিদ তৈরীর কাজে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নিজেও অংশ নেন এবং একজন সাধারণ শ্রমিকের মত কাজ করেন। প্রকৃত পক্ষে সেখানে তাঁকে অন্য শ্রমিকদের থেকে আলাদা করে চেনার কোন উপায় ছিল না।

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কখনোই কোন সাধারণ কাজ করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করতেন না। তিনি নিজের হাতে নিজের কাপড়-চোপড় সেলাই করতেন, নিজের জুতা মেরামত করতেন, বাজার করতেন, ছাগলের দুধ দোহন করতেন। এক্ষেত্রে তিনি আমাদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।

আযান প্রবর্তন

ইতিপূর্বেই আমরা জেনেছি যে, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মি'রাজের সময় মুসলমানদের জন্যে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরয করা হয়। মদীনায় মুসলমানরা একটি ঐক্যবদ্ধ ও সুসংঘবদ্ধ জনসমষ্টিতে পরিণত হন। তাই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এখানে জামা'আতে (একত্রিত হয়ে) নামাজ আদায়ের জন্যে মুসলমানদের ডাকার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন মনে করলেন।

এসময় সাধারণতঃ নামাজের ওয়াক্ত হলে মুসলামনরা পরস্পরকে ডেকে নিয়ে আসতেন। কিন্তু এতে অনেক সময় অসুবিধা হত। তাই এ ব্যাপারে বিভিন্ন সাহাবী বিভিন্ন পরামর্শ দেন। 

ইতিমধ্যে হযরত 'আবদুল্লাহ বিন যায়েদ বিন ছা'লাবাহ্ (রাঃ) নামাজের জন্যে ডাকার ব্যাপারে একটি স্বপ্ন দেখলেন। তিনি হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নিকট স্বপ্নটি বললেন। হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তা শুনে বললেন যে, এ স্বপ্ন একটি সত্য স্বপ্ন এবং তা আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে দেখানো হয়েছে।

তখন হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আবিসিনীয় বংশোদ্ভুত মুসলমান হযরত বিলাল (রাঃ) কে ডাকলেন। হযরত বিলাল (রাঃ)-এর কণ্ঠ ছিল খুবই সুন্দর ও গুরুগম্ভীর এবং তিনি উচ্চৈস্বরে ডাক দিলে তা খুবই দূর থেকে শোনা যেত। 

হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) হযরত বিলাল (রাঃ) কে হযরত 'আব্দুল্লাহ্ (রাঃ)-এর স্বপ্নে শোনা কথাগুলো উচ্চৈস্বরে ঘোষণা করে মুসলমানদেরকে নামাজের জন্যে ডাকতে বললেন । এ কথাগুলোর বাংলা উচ্চারন ও অর্থ ছিল

আযান বাংলাঃ
আযান লিরিক্সঃ
Azan Bengali:

আল্লাহু আকবার - ৪ বার 

আল্লাহ সর্বশক্তিমান

 

আশহাদু-আল লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ - ২ বার 

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই

 

আশহাদু-আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ - ২ বার 

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (স) আল্লাহর প্রেরিত দূত

 

হাইয়া আলাস্ সালা - ২ বার 

নামাজের জন্য এসো

 

হাইয়া আলাল ফালাহ্ - ২ বার 

সাফল্যের জন্য এসো

 

আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম - ২ বার

ঘুম হতে নামাজ উত্তম (শুধু ফজরের নামাজের জন্য)

 

আল্লাহু আকবার - ২ বার 

আল্লাহ্ মহান

 

 লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ - ১ বার 

আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই।

হযরত বিলাল (রাঃ) কথাগুলো উচ্চৈস্বরে ঘোষণা করলেন। এ ঘোষণা শুনে হযরত ‘ওমর (রাঃ) হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নিকট ছুটে এলেন এবং বললেন যে, তিনিও একই স্বপ্ন দেখেছেন।

একেই বলা হয় 'আযান' অর্থাৎ নামাজের জন্যে ঘোষণা এবং যিনি এ ঘোষণা দেন তাঁকে বলা হয় মুআযযিন। এভাবে হযরত বিলাল বিন রাবাহ্ (রাঃ) হলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মুআযযিন।

চমৎকার ও আকর্ষণীয় হৃদয়গ্রাহী আবেদনসহ এ আযান প্রচলিত হল এবং এর ফলে প্রতিদিন পাঁচবার মদীনায় আল্লাহর মহিমা ঘোষিত হতে লাগল। আযানের এ ব্যবস্থা এখনো বিশ্বের সকল মুসলিম-প্রধান দেশে প্রচলিত আছে। আযানে ব্যবহৃত কথাগুলোর ছন্দ ও ঝঙ্কার বিস্ময়কর ও খুবই উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী।

মুসলমানদের জন্যে আরো করণীয় নির্ধারণ

আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর একক ও গতিশীল নেতৃত্বে মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র ক্রমেই শক্তিশালী হতে লাগল। মদীনার ইসলামী সমাজের অধিকতর উন্নতি-অগ্রগতি ও কল্যাণের জন্যে আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) পক্ষ থেকে আরো হেদায়াত ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল। 

কারণ যদিও সমাজটি তখনো তার শৈশবকাল অতিক্রম করছিল, তথাপি তাকে গোটা মানবজাতির ইতিহাসে এক বিরাট ও স্থায়ী অবদান রাখতে হবে বলেই আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর মাধ্যমে এ সমাজের হেদায়াত ও প্রশিক্ষণের জন্যে প্রয়োজনীয় কর্মসূচী নাযিল করা হয়।

হিজরতের পরবর্তী দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচী নাযিল হয়। এ কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে রোযা ও যাকাতকে ফরয করা এবং মদ ও সূদকে হারাম করা। এ সময়ই ইয়াতীম, উত্তরাধিকার, বিবাহ ও বিবাহিতা নারীদের অধিকার সম্পর্কে আইন-কানুন নাযিল হয়।

এছাড়া হিজরত-পরবর্তী দ্বিতীয় বছরের শা'বান মাসে বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদুল আকছার পরিবর্তে মক্কা নগরীর কা'বাকে কিবলাহ্ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। (সূরাহ্ আল্-বাকারাহ্-১৪৪)

কঠিন দায়িত্ব

মদীনার ইসলামী সমাজ ক্রমেই বিকাশ লাভ করছিল। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নেতৃত্বে এ সমাজকে শক্তিশালী, সুসংহত ও গতিশীল করার কাজ অব্যাহত থাকে। এ সময় তাঁকে কার্যতঃ চারটি ক্ষেত্রে সংগ্রাম করতে হয়। তা হচ্ছে:

  • ১। ইসলামী সমাজের সকল পর্যায়ে সুসঙ্গতি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা।
  • ২। মুনাফিকদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা।
  • ৩। মক্কার কুরাইশদের থেকে সৃষ্ট বিপদ হতে সতর্ক থাকা এবং
  • ৪। মদীনার ইয়াহূদীদের অশুভ উদ্দেশ্য সম্পর্কে সাবধান থাকা।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কত চমৎকার ভাবে এসব বিপদ মোকাবিলা করেন এবং ইসলামী রাষ্ট্রকে ক্রমেই অধিকতর সাফল্যের দিকে ও শেষ পর্যন্ত বিশ্বের অন্য সকল জীবন-ব্যবস্থার ওপর ইসলামের বিজয়ের দিকে এগিয়ে নেন। 

আর আল্লাহ্ তা'আলার প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দায়িত্ব ছিল মানবরচিত জীবনব্যবস্থাসমূহের ওপর আল্লাহর দ্বীনকে (আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থাকে) বিজয়ী ও প্রাধান্যের অধিকারী করে দেয়া। (সূরাহ্ আত্-তাওবাহ্-৩৩)

ইসলামিক পিকচার

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url